ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর গত ৫ আগস্ট বিকেলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম নগরের বেশ কিছু এলাকা। ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলের ওপর গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। পরে মেয়র-এমপির বাড়ি, থানাসহ সরকারি নানা স্থাপনা ভাঙচুর ও আগুন দেয় উত্তেজিত জনতা। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা করে কয়েক হাজার আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। বিকেল ৫টার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চলে দফায় দফায় হামলা-সংঘর্ষ-গুলি।
সেদিন সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে গুলিবিদ্ধ অনেককে আনা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, প্রতি মিনিটে গুলিবিদ্ধ দুজনকে আনা হয় জরুরি বিভাগে। ৩০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালজুড়ে দেখা যায় গুলিবিদ্ধদের দীর্ঘ সারি। গুলিবিদ্ধদের সংখ্যা এক ঘণ্টায় পেরিয়ে শতকের ঘর! সেদিন রোগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে আহত কারও নাম তালিকাভুক্ত করার সময় পাননি স্বাস্থ্যকর্মীরা। গুলি কিনা দেখে শুধু কাগজে ওয়ার্ড নম্বর লিখে দেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় অনেককে চিকিৎসা নিতে হয় ট্রলির ওপর।
যাদের হাসপাতালে আনা হয়, তাদের অধিকাংশের বয়স ছিল ১৪ থেকে ৩০ বছর। গুলিতে সেদিন রক্তে ভিজে যায় জুলাইযোদ্ধাদের শার্ট-প্যান্ট। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় চিকিৎসক, সেবিকা, গুলিবিদ্ধ রোগী ও তাদের স্বজনদের।
সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি স্মরণ করে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন সমকালকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ রোগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে এত ডাক্তার-নার্স দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেদিনের ভয়াবহ মুহূর্তের কথা চিন্তা করলেই শরীর শিউরে ওঠে।’
সেদিন জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করা ডা. মো. তুহিন বলেন, ‘দুই চোখে যা দেখেছি, তা দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি। এত এত গুলি, এত এত মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণা আমার ডাক্তারি পেশায় আর দেখিনি। রোগীর চাপের কারণে কে কাকে দেখবে, কাকে স্যালাইন পুশ করবে, কাকে রক্ত দেবে– তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়।’
দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে গুলিবিদ্ধদেরও। জুলাই আন্দোলনে গিয়ে একাধিকবার হামলার শিকার হন জুলাইযোদ্ধা মো. মেহেদী। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে শামিল হতে গিয়ে গুলিতে রক্তাক্ত হন তিনি। মেহেদী বলেন, ‘মনসুরাবাদের পুলিশ লাইন্সে গিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ পায়ুপথ, ঊরুসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ি। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। কারণ, আমার চারপাশে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকার পর কয়েকজন মিলে একটি রিকশায় তুলে দেয়। সেই রিকশায় ছিল না চালক। শত কষ্টে হাসপাতালে আনার পরও ট্রলির ওপর পড়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। কারণ, জরুরি বিভাগে তখন গুলিবিদ্ধদের সারি পড়ে যায়। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন ও জুলাই আন্দোলন ঘিরে কয়েক দিনের গোলাগুলি, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় চমেক হাসপাতালে এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। আরও দুই শতাধিক চিকিৎসা নেন কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন চার শতাধিক। গত ৫ আগস্ট এক দিনেই তিন শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন।