একমঞ্চে দেখা গেল তিন নেতা—চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের দিনটি সাড়ম্বর উদ্যাপন করছে চীন। দিনটিকে ঘিরে গতকাল বুধবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। এতে যোগ দেন ওই তিন নেতা। পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে মিত্রদের নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের এক সপ্তাহের কূটনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের সমাপ্তি ঘটল এ আয়োজনে।
গতকাল চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের লালগালিচা ধরে হাঁটার সময় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যই দেখেছে বিশ্ববাসী। সেখানে পুতিন ও কিম জং–উনের সঙ্গে হাত মেলানোর পাশাপাশি শুভেচ্ছে বিনিময় করছেন সি। এ সময় সির ডান পাশে পুতিন ও বাঁপাশে কিমকে দেখা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান আসলে ছিল সির জন্য এক মহাসমারোহ। এ আয়োজনের মাধ্যমে তিনি চীনের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেন এবং মিত্রদেশগুলোর নেতাদের একত্র করে বিশ্বকে একটি বার্তা দেন।
কুচকাওয়াজ উদ্বোধন করে প্রেসিডেন্ট সি সতর্ক করে বলেন, বিশ্ব এখনো ‘শান্তি নাকি যুদ্ধ—এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার’ মুখোমুখি। তবে তিনি বলেন, চীনকে থামানো অসম্ভব।
প্রদর্শিত বিপুল সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ে চীনের নতুন আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৫সি, যার পাল্লা ২০ হাজার কিলোমিটার।
চীনের অত্যন্ত গোছানো এই অনুষ্ঠান ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সি, পুতিন ও কিম—এ তিন নেতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন ‘ভ্লাদিমির পুতিন আর কিম জং–উনকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে দাও। যেহেতু তোমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ।’
সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শন
দেড় ঘণ্টার কুচকাওয়াজে খোলা ছাদওয়ালা লিমুজিনে চড়ে বেইজিংয়ের বিশাল চাং আন অ্যাভিনিউ ধরে সারিবদ্ধ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র পরিদর্শন করেন সি। এরপর ফিরে গিয়ে অতিথিদের সঙ্গে বসেন তিয়েনআনমেনের মাও সে–তুংয়ের প্রতিকৃতির নিচে তৈরি আসন এলাকায়। এটি ঐতিহাসিক ফরবিডেন সিটির প্রবেশদ্বার।
চীনের বিপুলসংখ্যক সামরিক যান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র একে একে শোভাযাত্রায় অংশ নেয় সম্মানিত অতিথিদের সামনে। আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি প্রদর্শনীতে ছিল নতুন আন্ডারওয়াটার ড্রোন, সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ সর্বাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম।
উড়োজাহাজের চমৎকার মহড়া দেখতে বেইজিংয়ের বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসেন। মহড়ায় অসংখ্য যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার অংশ নেয়।
বিশ্বের নজর ছিল সি, পুতিন ও কিম কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে একমঞ্চে ওঠেন, তার দিকে। উত্তর কোরিয়ার নেতা সচরাচর দেশের বাইরে যান না। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে তিন নেতার একসঙ্গে থাকার দৃশ্য কেবল কিছুটা দেখানো হয়। ছবি বা ভিডিও করতে বিদেশি সাংবাদিকদের নিষেধ করা হয়।
চীনের তিয়ানজিন শহরে বিশ্বের ২০টি দেশের নেতাদের নিয়ে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) সম্মেলন শেষ হয় গত সোমবার। এরপরই এ সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হলো। এসসিও সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চীনকে স্থাপন করা। এসসিও নিজেদের আঞ্চলিক সহযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু ও পশ্চিমা জোটের বিকল্প হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছে।
দুই দিনের এসসিও সম্মেলনের শেষ দিনে সি একটি দেশের বিরুদ্ধে পীড়নমূলক আচরণের সমালোচনা করেন। তিনি কোনো দেশের নাম প্রকাশ না করলেও মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেন।
অন্যদিকে পুতিন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে সঠিক বলে দাবি করেন এবং এ সংঘাতের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোকে দায়ী করেন।
তিয়ানজিন সম্মেলনের অতিথিদের মধ্যে পুতিন, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোসহ আরও কয়েকজন নেতা সির সঙ্গে বেইজিংয়ের কুচকাওয়াজে যোগ দেন। তবে ২০ জনের বেশি বিশ্বনেতার উপস্থিতি সত্ত্বেও এ আয়োজনে কোনো বড় পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রনেতা অংশ নেননি।
রাজনৈতিক প্রভাব
বিভিন্ন দেশের নেতাদের আগমন উপলক্ষে বেইজিংজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। সড়ক বন্ধ রাখা, সেতু ও রাস্তার মোড়ে সেনা মোতায়েন এবং রাজধানীর প্রশস্ত সড়কগুলোয় মাইলের পর মাইল ব্যারিকেড বসানো হয়।
চীন এই কুচকাওয়াজকে ঐক্যের প্রদর্শনী হিসেবে তুলে ধরেছে।
এই সফরে কিমের সঙ্গে ছিলেন তাঁর মেয়ে কিম জু আয়ে, যাঁকে বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর সময় দেখা গেছে এবং তাঁর বোন কিম ইয়ো জং, যিনি গতকাল এক গালা লাঞ্চে এএফপির ছবিতে ধরা পড়েন।
গতকালের কুচকাওয়াজ শেষে পুতিন ও কিম বৈঠক করেন। বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তা দিতে উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েনের জন্য কিমকে ধন্যবাদ জানান।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষণা ফেলো লাম পেং এর বলেন, কিমের এই সফর উত্তর কোরিয়ার জনগণ ও বিশ্বকে দেখিয়েছে যে শক্তিশালী রুশ ও চীনা বন্ধু আছে কিমের, যাঁরা তাঁকে সম্মান দিয়ে গ্রহণ করেন।
লাম পেং আরও বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতাদের একত্র করার ক্ষমতা থাকার বিষয়টি প্রদর্শন করছে চীন। দেশটি যে পুতিন ও কিম জং–উনকে একই মঞ্চে নিয়ে আসতে সক্ষম, তা–ও দেখিয়ে দিয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো