ঢাকা ০৬:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম- উদীচী রাজধানীর ভালোবাসা নিয়ে এলো পেনোয়া টাকার নকশায় বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবের ছবি কচ্ছপিয়ার সাহাব উদ্দিন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম নিষেধাজ্ঞার মাঝেও সেন্টমার্টিনে প্লাস্টিক যাচ্ছে দেদারসে! রামুর বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম চৌধুরীর মৃত্যু, জানাযা কাল অপরিকল্পিত স্থাপনা-দূষণে বাস অনুপযোগী হয়ে উঠছে কক্সবাজার সিবিআইইউ জার্নালিস্ট সোসাইটি গঠিত, সভাপতি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের তাহজীবুল-সম্পাদক টিটিএনের সাজিন টেকনাফে কিশোরকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো: রাষ্ট্রপক্ষকে খোঁজ নিতে বললেন হাইকোর্ট আইএলও-আইএসইসি পর্যটন সেক্টর সাপোর্ট ইমপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপ ও এমবোলডেন বাংলাদেশের মধ্যে টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ঈদগাহ মানবিক ফাউন্ডেশনের জার্সি উন্মোচন রামুতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব উদযাপন পরিষদ গঠিত কক্সবাজারে পর্যটন ও আথিতেয়তা খাতে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত কক্সবাজারে ‘লিংরোড বাজার কমিটির’ নেতাকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ পরিবারের কথা বলতে পারেন না-শুনেনও না, জাবেদ পড়েন অনার্সে

শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে লাভ কী?

শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে আসলে লাভ কী? লাভ অবশ্যই আছে। সেই লাভ আসে দীর্ঘমেয়াদে। লাভ যখন আসতে শুরু করবে তখন বিনিয়োগকারী হিসেবে সেই সরকার বা ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় না থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাই তখন লাভ বা সুবিধা ভোগ করবে অন্য সরকার বা ক্ষমতাসীন দল। এক সরকার বা এক দলের বিনিয়োগের ফসল অন্য সরকার বা দল পাবে এটা আমাদের দেশের কোনো সরকার বা দল মানতে পারে না।

বিনিয়োগের আসল লাভ দেশ এবং দেশের জনগণ পাবে এটা আমাদের কোনো রাজনৈতিক দলই মানতে নারাজ। দেশের লাভ যে নিজের লাভের ঊর্ধ্বে এটা বোঝার মতো জ্ঞান বা দূরদৃষ্টি আমাদের কারও নেই। যেই বিনিয়োগে নগদ লাভ তার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি লাভ অনেক বেশি টেকসই। সেই লাভ দেখতে হলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়।

শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এই বিনিয়োগ আসতে পারে। বিনিয়োগ তখনই আসবে তখন সরকার বা বেসরকারি পর্যায়ের বিত্তশালীদের সদিচ্ছা থাকবে। প্রশ্ন হলো, সেই সদিচ্ছা কি আছে?

একটি দেশ যখন লেখাপড়া ও গবেষণায় এগিয়ে যায় তখন অন্য সব দিকের উন্নয়ন সাথে সাথে আগাতে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া শিক্ষা ও গবেষণায় অভাবনীয় গতিতে এগিয়েছে। তাদের গাড়ি কিয়া (Kia) এবং হুন্দাই (Hyundai) এখন বিশ্ববাজারে রাজত্ব করছে। ওদের স্যামসাং এবং এলজি বিশ্বের ইলেকট্রনিক্স বাজারে রাজত্ব করছে। ওদের সিনেমা এখন বিশ্বমানের।

এইবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হ্যান কাং (Han Kang)। তিনিও একজন দক্ষিণ কোরিয়ান। সবকিছুর মূলে যে শিক্ষা ও গবেষণা এই ছোট জিনিসটাই আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম না।

শিক্ষা ও গবেষণা যে কেবল সার্টিফিকেট এবং যেখানে সেখানে গবেষণা প্রকাশ নয় সেটাও আমরা বুঝি না। অর্থাৎ সৎ, ভালো চিন্তা করার মতো মানুষই তৈরি করতে পারিনি। দেখুন, যারা দেশ গড়ার দায়িত্বে ছিল তারা কীভাবে দেশকে শূন্য করে দিয়েছে। সুন্দর সভ্য দেশের নাগরিক হওয়ার গর্ব থেকে নিজেকে এবং দেশের মানুষকে বঞ্চিত করছে।

শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বেসরকারিভাবে ভারত কীভাবে ভূমিকা রাখছে তা জানা জরুরি। আম্বানি আর টাটা দুই পরিবারই ধনী। এই দুই ধনীর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। একজন ধনদৌলত অর্জনের সাথে সাথে তা প্রচারে ব্যস্ত। আম্বানি পরিবার তাদের সদস্যের বিয়েতে কোটি ডলারের অলংকার, পপ তারকা, অন্যান্য ধনী তারকাদের এনে সংবাদ শিরোনাম হয়।

আমাদের দেশের বিত্তশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে? এই দেশের ধনীরা প্রথমত চুরি আর ডাকাতি করে ধনী হয়, এরপর বিদেশে অর্থ পাচার করে স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে অঢেল সম্পদ দিয়ে রেখে আসে। দেশকে তারা মূলত ব্যবহার করে।

অপরদিকে টাটা তার মোট সম্পদের প্রায় ৬০ শতাংশ মানব কল্যাণে ব্যয় করেছে। এই পরিবার ভারতের অনেক বিশ্বখ্যাত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। টাটা গ্রুপের বৈশিষ্ট্য কী? তারা কি টাকার গরম দেখায়? তারা কি এমপি মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে আছে? তারা অর্থ ও মনে দুইভাবেই প্রচণ্ড ধনী। এদের হাতে ভারতের সেরা অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এর মধ্যে একটি হলো ভারতের মুম্বাইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (Tata Institute of Fundamental Research – TIFR)। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালে, যখন রাজনীতি, অর্থসম্পদ ও একাডেমিয়ার তিন দিকপাল যথাক্রমে জওহরলাল নেহেরু (Jawaharlal Nehru), দোরাবজি টাটা (Dorabji Tata) এবং হোমি ভাভা (Homi J. Bhabha) একত্রিত হন।

২০০৭ সালে সেই TIFR এর একটি ব্রাঞ্চ বেঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয় যার নাম দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল সাইন্স (International Centre for Theoretical Sciences – ICTS)! এই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে পদার্থবিদ হিসেবে আছেন ভারতের সেরা সব বিজ্ঞানী যেমন অশোক সেন, দীপক ধর, অভিষেক ধরসহ অনেকেই।

ভারতের বড় বড় ধনীরা বিদেশে টাকা পাচার করে না। তারা ব্যাংক ডাকাতি করে না। তাদের অনেকেই শিক্ষায় ডোনেশন দেয়। ভারতের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হলো টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ যেটি টাটা গ্রুপের অর্থে প্রতিষ্ঠিত এবং এর পেছনের ইন্টেলেকচুয়াল স্থপতি ছিলেন হোমি ভাভা (Homi J. Bhabha)।

এছাড়া কলকাতায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সাইন্স (Indian Association for the Cultivation of Science – IACS) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার (Dr. Mahendralal Sarkar)-এর নেতৃত্বে মানুষের দানে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (Indian Statistical Institute – ISI) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ (Prasanta Chandra Mahalanobis)-এর দানে এবং নেতৃত্বে। বর্তমানে ভারতের সেরা ধনীদের অন্যতম হলেন আজিম প্রেমজি এবং তার পরিবার। সম্প্রতি তারা ১ হাজার ৭ শত ৭৪ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছেন। বিড়লা পরিবার (Birla family) প্রায় ৩০০ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছে।

এইবার ভাবুন বাংলাদেশের কথা। আমাদের দেশের বিত্তশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে? এই দেশের ধনীরা প্রথমত চুরি আর ডাকাতি করে ধনী হয়, এরপর বিদেশে অর্থ পাচার করে স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে অঢেল সম্পদ দিয়ে রেখে আসে। দেশকে তারা মূলত ব্যবহার করে।

স্বাধীনতার পর একজনকেও দেখলাম না বড় আকারে অর্থ দান করে বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। যদিওবা কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, সেটাও গড়ে আরও অর্থ উপার্জনের জন্য। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা।

এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে মারামারি, খুন আর দলাদলি। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের নোংরা রাস্তাঘাট, দূষিত খাল-বিল-নদী দেখলেই বোঝা যায়।

এত বছর হয়ে গেল এখনো একটি গবেষণা ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেনি। না সরকার, না ব্যক্তি কেউ এইদিকে ঝুঁকেনি। অথচ সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছে কিন্তু এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য শিক্ষক জোগান দেওয়ার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আজও গড়ে উঠেনি। গবেষণায় উন্নতি না করে পৃথিবীর এমন একটি দেশও কি আছে যেই দেশ উন্নত হয়েছে? লেখাপড়াবিহীন ধনী মানে সেই মানুষ হবে রাক্ষস, অসভ্য, বর্বর; যার সব লক্ষণ এবং উদাহরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান।

আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে মারামারি, খুন আর দলাদলি। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের নোংরা রাস্তাঘাট, দূষিত খাল-বিল-নদী দেখলেই বোঝা যায়।

আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের রাজনৈতিক মিছিল, মিটিং ও পোস্টারের মান দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের পত্রিকা ও টেলিভিশনের মান দেখলেও তা বোঝা যায়। এত দেখেও আমাদের বোধোদয় না হওয়াতে বোঝা যায় আমরা কতটা অসভ্য।

সব দেখে মনে হয় আমরা দেশের চেয়েও দলকে আর দলের চেয়েও নিজেকে বেশি ভালোবাসি। এটা করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে বঞ্চিত করি, অন্যের অধিকার হরণ করি, অন্যের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলি। আমরা জানি না যে অন্যরা ভালো না থাকলে আমি বা আমার সন্তান ভালো থাকার পরিবেশ পাবে না।

রতন টাটা ৮৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করলেন। কী অসাধারণ এক জীবন যাপন করে গেলেন তিনি। কত সহস্র মানুষের কর্মসংস্থান করে গেলেন। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরো টাটা পরিবারের সাম্রাজ্য। একটা পরম্পরা তৈরি করেছে তারা। জামশেদ জি টাটা এটি স্থাপন করে গেছেন। এই পর্যন্ত টাটা গ্রুপের ৬ জেনারেশন চেয়ারম্যান হয়েছেন।

আমাদের দেশে এক জেনারেশন সাম্রাজ্য বানায় আর পরের জেনারেশনই ভোগ বিলাস আর পারিবারিক দ্বন্দ্বে ধ্বংস হয়। আজ পর্যন্ত কোনো টেকসই ধনী তৈরি হয়নি। হবে কীভাবে? মানুষের রক্ত চুষে, টাকা পাচার করে, চুরি-ডাকাতি করে বড়লোক হয়। ফলে তাদের সন্তানরা হয় ততধিক খুনি, বাটপার।

অতিরিক্ত সম্পদ মানব দেহের মেদের মতো। এরপর যত বেশি হবে ততবেশি ক্ষতিকর হবে। এই অতিরিক্ত অংশ মানব কল্যাণে যারা ব্যয় করে তারাই টিকে থাকে ঠিক যেমন টিকে আছে টাটা গ্রুপ। আর বাকিরা কী করছে তা আপনারাই দেখছেন। আসলে এই দেশের মূল সমস্যা শিক্ষা ও গবেষণায়। এখানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে; তা কবে বুঝবে সরকার, দেশের বিত্তশালীরা?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম- উদীচী

This will close in 6 seconds

শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে লাভ কী?

আপডেট সময় : ১০:২৮:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লে আসলে লাভ কী? লাভ অবশ্যই আছে। সেই লাভ আসে দীর্ঘমেয়াদে। লাভ যখন আসতে শুরু করবে তখন বিনিয়োগকারী হিসেবে সেই সরকার বা ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় না থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাই তখন লাভ বা সুবিধা ভোগ করবে অন্য সরকার বা ক্ষমতাসীন দল। এক সরকার বা এক দলের বিনিয়োগের ফসল অন্য সরকার বা দল পাবে এটা আমাদের দেশের কোনো সরকার বা দল মানতে পারে না।

বিনিয়োগের আসল লাভ দেশ এবং দেশের জনগণ পাবে এটা আমাদের কোনো রাজনৈতিক দলই মানতে নারাজ। দেশের লাভ যে নিজের লাভের ঊর্ধ্বে এটা বোঝার মতো জ্ঞান বা দূরদৃষ্টি আমাদের কারও নেই। যেই বিনিয়োগে নগদ লাভ তার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি লাভ অনেক বেশি টেকসই। সেই লাভ দেখতে হলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়।

শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এই বিনিয়োগ আসতে পারে। বিনিয়োগ তখনই আসবে তখন সরকার বা বেসরকারি পর্যায়ের বিত্তশালীদের সদিচ্ছা থাকবে। প্রশ্ন হলো, সেই সদিচ্ছা কি আছে?

একটি দেশ যখন লেখাপড়া ও গবেষণায় এগিয়ে যায় তখন অন্য সব দিকের উন্নয়ন সাথে সাথে আগাতে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া শিক্ষা ও গবেষণায় অভাবনীয় গতিতে এগিয়েছে। তাদের গাড়ি কিয়া (Kia) এবং হুন্দাই (Hyundai) এখন বিশ্ববাজারে রাজত্ব করছে। ওদের স্যামসাং এবং এলজি বিশ্বের ইলেকট্রনিক্স বাজারে রাজত্ব করছে। ওদের সিনেমা এখন বিশ্বমানের।

এইবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হ্যান কাং (Han Kang)। তিনিও একজন দক্ষিণ কোরিয়ান। সবকিছুর মূলে যে শিক্ষা ও গবেষণা এই ছোট জিনিসটাই আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম না।

শিক্ষা ও গবেষণা যে কেবল সার্টিফিকেট এবং যেখানে সেখানে গবেষণা প্রকাশ নয় সেটাও আমরা বুঝি না। অর্থাৎ সৎ, ভালো চিন্তা করার মতো মানুষই তৈরি করতে পারিনি। দেখুন, যারা দেশ গড়ার দায়িত্বে ছিল তারা কীভাবে দেশকে শূন্য করে দিয়েছে। সুন্দর সভ্য দেশের নাগরিক হওয়ার গর্ব থেকে নিজেকে এবং দেশের মানুষকে বঞ্চিত করছে।

শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বেসরকারিভাবে ভারত কীভাবে ভূমিকা রাখছে তা জানা জরুরি। আম্বানি আর টাটা দুই পরিবারই ধনী। এই দুই ধনীর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। একজন ধনদৌলত অর্জনের সাথে সাথে তা প্রচারে ব্যস্ত। আম্বানি পরিবার তাদের সদস্যের বিয়েতে কোটি ডলারের অলংকার, পপ তারকা, অন্যান্য ধনী তারকাদের এনে সংবাদ শিরোনাম হয়।

আমাদের দেশের বিত্তশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে? এই দেশের ধনীরা প্রথমত চুরি আর ডাকাতি করে ধনী হয়, এরপর বিদেশে অর্থ পাচার করে স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে অঢেল সম্পদ দিয়ে রেখে আসে। দেশকে তারা মূলত ব্যবহার করে।

অপরদিকে টাটা তার মোট সম্পদের প্রায় ৬০ শতাংশ মানব কল্যাণে ব্যয় করেছে। এই পরিবার ভারতের অনেক বিশ্বখ্যাত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। টাটা গ্রুপের বৈশিষ্ট্য কী? তারা কি টাকার গরম দেখায়? তারা কি এমপি মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে আছে? তারা অর্থ ও মনে দুইভাবেই প্রচণ্ড ধনী। এদের হাতে ভারতের সেরা অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এর মধ্যে একটি হলো ভারতের মুম্বাইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (Tata Institute of Fundamental Research – TIFR)। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালে, যখন রাজনীতি, অর্থসম্পদ ও একাডেমিয়ার তিন দিকপাল যথাক্রমে জওহরলাল নেহেরু (Jawaharlal Nehru), দোরাবজি টাটা (Dorabji Tata) এবং হোমি ভাভা (Homi J. Bhabha) একত্রিত হন।

২০০৭ সালে সেই TIFR এর একটি ব্রাঞ্চ বেঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয় যার নাম দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল সাইন্স (International Centre for Theoretical Sciences – ICTS)! এই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে পদার্থবিদ হিসেবে আছেন ভারতের সেরা সব বিজ্ঞানী যেমন অশোক সেন, দীপক ধর, অভিষেক ধরসহ অনেকেই।

ভারতের বড় বড় ধনীরা বিদেশে টাকা পাচার করে না। তারা ব্যাংক ডাকাতি করে না। তাদের অনেকেই শিক্ষায় ডোনেশন দেয়। ভারতের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হলো টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ যেটি টাটা গ্রুপের অর্থে প্রতিষ্ঠিত এবং এর পেছনের ইন্টেলেকচুয়াল স্থপতি ছিলেন হোমি ভাভা (Homi J. Bhabha)।

এছাড়া কলকাতায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সাইন্স (Indian Association for the Cultivation of Science – IACS) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার (Dr. Mahendralal Sarkar)-এর নেতৃত্বে মানুষের দানে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (Indian Statistical Institute – ISI) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ (Prasanta Chandra Mahalanobis)-এর দানে এবং নেতৃত্বে। বর্তমানে ভারতের সেরা ধনীদের অন্যতম হলেন আজিম প্রেমজি এবং তার পরিবার। সম্প্রতি তারা ১ হাজার ৭ শত ৭৪ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছেন। বিড়লা পরিবার (Birla family) প্রায় ৩০০ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছে।

এইবার ভাবুন বাংলাদেশের কথা। আমাদের দেশের বিত্তশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে? এই দেশের ধনীরা প্রথমত চুরি আর ডাকাতি করে ধনী হয়, এরপর বিদেশে অর্থ পাচার করে স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে অঢেল সম্পদ দিয়ে রেখে আসে। দেশকে তারা মূলত ব্যবহার করে।

স্বাধীনতার পর একজনকেও দেখলাম না বড় আকারে অর্থ দান করে বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। যদিওবা কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, সেটাও গড়ে আরও অর্থ উপার্জনের জন্য। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা।

এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে মারামারি, খুন আর দলাদলি। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের নোংরা রাস্তাঘাট, দূষিত খাল-বিল-নদী দেখলেই বোঝা যায়।

এত বছর হয়ে গেল এখনো একটি গবেষণা ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেনি। না সরকার, না ব্যক্তি কেউ এইদিকে ঝুঁকেনি। অথচ সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছে কিন্তু এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য শিক্ষক জোগান দেওয়ার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আজও গড়ে উঠেনি। গবেষণায় উন্নতি না করে পৃথিবীর এমন একটি দেশও কি আছে যেই দেশ উন্নত হয়েছে? লেখাপড়াবিহীন ধনী মানে সেই মানুষ হবে রাক্ষস, অসভ্য, বর্বর; যার সব লক্ষণ এবং উদাহরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান।

আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে মারামারি, খুন আর দলাদলি। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের নোংরা রাস্তাঘাট, দূষিত খাল-বিল-নদী দেখলেই বোঝা যায়।

আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের রাজনৈতিক মিছিল, মিটিং ও পোস্টারের মান দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের পত্রিকা ও টেলিভিশনের মান দেখলেও তা বোঝা যায়। এত দেখেও আমাদের বোধোদয় না হওয়াতে বোঝা যায় আমরা কতটা অসভ্য।

সব দেখে মনে হয় আমরা দেশের চেয়েও দলকে আর দলের চেয়েও নিজেকে বেশি ভালোবাসি। এটা করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে বঞ্চিত করি, অন্যের অধিকার হরণ করি, অন্যের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলি। আমরা জানি না যে অন্যরা ভালো না থাকলে আমি বা আমার সন্তান ভালো থাকার পরিবেশ পাবে না।

রতন টাটা ৮৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করলেন। কী অসাধারণ এক জীবন যাপন করে গেলেন তিনি। কত সহস্র মানুষের কর্মসংস্থান করে গেলেন। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরো টাটা পরিবারের সাম্রাজ্য। একটা পরম্পরা তৈরি করেছে তারা। জামশেদ জি টাটা এটি স্থাপন করে গেছেন। এই পর্যন্ত টাটা গ্রুপের ৬ জেনারেশন চেয়ারম্যান হয়েছেন।

আমাদের দেশে এক জেনারেশন সাম্রাজ্য বানায় আর পরের জেনারেশনই ভোগ বিলাস আর পারিবারিক দ্বন্দ্বে ধ্বংস হয়। আজ পর্যন্ত কোনো টেকসই ধনী তৈরি হয়নি। হবে কীভাবে? মানুষের রক্ত চুষে, টাকা পাচার করে, চুরি-ডাকাতি করে বড়লোক হয়। ফলে তাদের সন্তানরা হয় ততধিক খুনি, বাটপার।

অতিরিক্ত সম্পদ মানব দেহের মেদের মতো। এরপর যত বেশি হবে ততবেশি ক্ষতিকর হবে। এই অতিরিক্ত অংশ মানব কল্যাণে যারা ব্যয় করে তারাই টিকে থাকে ঠিক যেমন টিকে আছে টাটা গ্রুপ। আর বাকিরা কী করছে তা আপনারাই দেখছেন। আসলে এই দেশের মূল সমস্যা শিক্ষা ও গবেষণায়। এখানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে; তা কবে বুঝবে সরকার, দেশের বিত্তশালীরা?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়