শুরুটা হয়েছিল একটা স্যুটকেস থেকে কিংবা একটা ন্যাপকিন পেপার অথবা একটা বাইসাইকেল থেকে। সেসব তখন ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। ধীরে ধীরে ঘটনাগুলো জোড়া লেগে রূপান্তরিত হলো একটা পূর্ণাঙ্গ গল্পে। স্মৃতির সেসব পাথরখণ্ড এখন গল্পের জগৎ পেরিয়ে মিথ বা কিংবদন্তিতে রূপ নিয়েছে। কে জানে, হয়তো কোনো এক মনোরম মনোটোনাস সকালে কফির মগ হাতে মনে মনে সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন রূপকথার সেই মহানায়ক, যাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এই অনবদ্য গল্পগাথা।
রূপকথার সেই গল্পের মহানায়কের নামটা যে লিওনেল মেসি, তা বোধ হয় আলাদা করে না বললেও চলে। আজ ৩৮তম জন্মদিনে মেসি কি আরেকবার সেসব রূপকথার দিকে ফিরে তাকাবেন? হয়তো তাকাবেন, হয়তো না। কিন্তু আমরা তো কাঁটায় হেঁটে মুকুটের সন্ধান পাওয়া সেই গল্পটার দিকে ফিরে তাকাতেই পারি।
একজন মানুষের দেবদূত হয়ে ওঠার যাত্রাটা আরেকবার দেখে নিয়ে বলতে পারি, ‘এমন মানবজনম আর কি হবে।’ নাহ, এমনটা সব সময় হয় না। কখনো কখনো হয়, কদাচিৎ কেউ কেউ আসেন প্রকৃতির বর নিয়ে। যাঁর হাতে প্রকৃতি তুলে দেয় হ্যারি পটারের সেই জাদুর ছড়ি, যা মুহূর্তেই মাটিকে বদলে দিতে পারে হীরকখণ্ডে।
কিন্তু অমরত্বের পর আর কী? আর্জেন্টাইন সাহিত্যিক রবার্তো ফুনতানারোজার ‘এন আর্জেন্টাইন’স হেভেন’ নামক গল্পে একদল মানুষ মৃত্যুর পরে কীভাবে ফুটবল খেলা দেখার মধ্য দিয়ে স্বর্গে আরোহণ করেছিলেন সেটা দেখিয়েছিলেন। ফুটবলীয় সেই স্বর্গ কাতারে আড়াই বছর আগেই পেয়ে গেছেন মেসি। আঙুলের ইশারায় পুরো পৃথিবীকে একাই নাচিয়ে তুলেছিলেন ট্যাঙ্গোর তালে। কিন্তু এরপর? অমরত্বের পর সত্যিই কি কিছু থাকে? হ্যাঁ থাকে। অমরত্বের পর থাকে উপভোগ। অমরত্বের পর থাকে বয়ে যাওয়া।
মেসির কোনো আকাঙ্ক্ষা না থাকতে পারে, আমাদের তো চাওয়ার শেষ নেই। আমরা তো চাই মেসি অনন্তকাল ধরে খেলে যাক। আমাদের ক্লিশে জীবনটা কিছু মুহূর্তের জন্য হীরণ্ময় হয়ে উঠুক।
মেসির কোনো আকাঙ্ক্ষা না থাকতে পারে, আমাদের তো চাওয়ার শেষ নেই। আমরা তো চাই মেসি অনন্তকাল ধরে খেলে যাক। আমাদের ক্লিশে জীবনটা কিছু মুহূর্তের জন্য হীরণ্ময় হয়ে উঠুক। আমার বারবার মেতে উঠি সুতীব্র উল্লাসে। কিন্তু সব ভালো কিছুই তো কখনো না কখনো শেষ হতে হয়। সব চাওয়া–পাওয়া একদিন জীবনানন্দ দাশের ‘সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন’ লাইনটার মতো অন্তিমে এসে পৌঁছায়। জীবনের এই অমোঘ নিয়ম মেনে মেসিও হয়তো বুটের ধুলো মুছতে মুছতে উদ্যাপন করছেন নিজের ৩৮তম জন্মদিন।
মেসি চাইলে অবশ্য সেই ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই বিদায় বলে দিতে পারতেন। অমরত্বের মধু গলায় ধারণ করেই চলে যেতে পারতেন ফুটবলের মঞ্চ ছেড়ে। কিন্তু বয়ে যাওয়ার স্বাদটা পেতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো আরও কিছু সময়ের জন্য থেকে গেলেন। আরও কিছু অমর দৃশ্য রচনা করলেন। কিন্তু অতিরিক্ত সময়েরও যে শেষ আছে, মেসির এবারের জন্মদিনটা সে কথাই যেন বারবার মনে করে দিচ্ছে। তবে গল্পের নায়ক গোধূলিবেলায় বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে নিতে বিদায়ের বিউগলটা নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন।
২০২৬ বিশ্বকাপে সেই বিউগল বাজিয়ে ইতি টানবেন সব আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া–পাওয়ার। সেই মঞ্চে মেসি শেষ পর্যন্ত সফল হোন বা ব্যর্থ, মাথা উঁচু করে মহানায়কের বেশে নিজেই নামিয়ে দেবেন নাট্যমঞ্চ থেকে বিদায়ের পর্দাটা।
যে রাতে মেসি ‘আর্জেন্টাইন হেভেনে’ চিরন্তন হলেন
লেখার শুরুতে একটা স্যুটকেসের কথা বলা হয়েছে। মেসির সেই স্যুটকেসের গল্পটা বলেছিলেন আর্জেন্টাইন সাহিত্যিক হারনান কাসসিয়ারি। বিশ্বকাপ জিতে রেডিওতে সেই গল্প শুনে মেসি নিজেই কেঁদেছিলেন। গল্পে কাসসিয়ারি বলেছেন, ‘দুই ধরনের অভিবাসী আছেন। একধরনের হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা স্পেনে পৌঁছে নিজেদের স্যুটকেস আলমারিতে উঠিয়ে রাখেন এবং আরেক দল আছেন যাঁরা বাইরে রাখেন। দ্বিতীয় দলের হচ্ছেন সেই মানুষগুলো, যাঁরা নিজেদের শিকড় ভুলতে পারেন না। মেসি সেই দ্বিতীয় দলের একজন। যিনি তাঁর গাউচো উচ্চারণ অক্ষুণ্ন রেখেছেন।’
অথচ এই মেসির দেশপ্রেম নিয়ে একসময় প্রশ্ন তুলেছিলেন আর্জেন্টাইনরা। একের পর এক ব্যর্থতায় কোণঠাসা মেসি হার মেনে নিয়ে বিদায়ও বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এসব কাঁটা বিছানো পথে না হেঁটে যে অমরত্ব লাভের অন্য কোনো পথও যে ছিল না। আর ন্যাপকিনকে চুক্তিপত্র বানিয়ে যে ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল, সেটা তো এমন নাটকীয়ই হবে। বাইসাইকেলের গল্পটাও তেমনই। ছোট্ট মেসি সেদিন ফাইনালের আগে আটকে পড়েছিলেন টয়লেটে। একপর্যায়ে কোনো উপায় না দেখে টয়লেটের জানালা ভেঙে মাঠে নেমে দলকে জিতিয়ে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন স্বপ্নের বাইসাইকেল।
সেই বাইসাইকেলটাই একদিন বিশ্বকাপ ট্রফিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। যে ট্রফির জন্য অভিযানে বেরোনো মেসিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাও। অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতার সেই উপাখ্যানগুলোই একটু একটু করে তৈরি করেছে মেসিকে। শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে তাঁর স্বপ্নকে। যে স্বপ্ন মেসি শেষ পর্যন্ত পূরণ করেছেন এশিয়ায় এসে। এখন অপেক্ষা আরেকটি মহাদেশ তথা উত্তর আমেরিকায় গিয়ে ট্রফিটিকে দ্বিগুণ করার। নামটা যখন মেসি, স্বপ্নটা মোটেই অবাস্তব কিছু নয়।
অথচ এই মেসির দেশপ্রেম নিয়ে একসময় প্রশ্ন তুলেছিলেন আর্জেন্টাইনরা। একের পর এক ব্যর্থতায় কোণঠাসা মেসি হার মেনে নিয়ে বিদায়ও বলে দিয়েছিলেন।
এখন মেসির অবসরের পর বা মেসিবিহীন ফুটবল আসলে কেমন হবে, সেটা অনুমান করে কেউ চাইলে তেমন কিছু আয়োজন করতে পারে। যা আমাদের মনে করিয়ে দেবে, আমরা এখন মেসির না থাকার সেই সময়টার খুবই নিকটে এসে পড়েছি। ২০২৬ বিশ্বকাপ যতই এগিয়ে আসবে, শূন্যতার এই অনুভূতি আরও তীব্র হবে।
অতিনাটকীয় কিছু না হলে আমরা হয়তো ফুটবলার হিসেবে সক্রিয় মেসির আরেকটি জন্মদিন উদ্যাপন করতে পারব। ২০২৬ বিশ্বকাপের উত্তেজনা যখন চূড়ায় থাকবে, তখনই নিজের ৩৯তম উদ্যাপনটি করবেন মেসি। আরেকটি বিশ্বকাপ জিতেই হয়তো সেই জন্মদিনটা রাঙাতে চাইবেন তিনি।
তবে সেই অর্জন আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দেওয়া মেসির নয়, সেটা হবে তাঁকে যাঁরা ভালোবেসে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছেন, তাঁদের অর্জন। মেসিপ্রেমীদের জন্যও অবশ্য এই অর্জন খুব জরুরি কিছু নয়। তারা তো মাঠে স্থির হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মেসিকে দেখেও অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবে। ভালোবাসা নামের দুর্লভ বস্তুটা যে এমনই!
সূত্র: প্রথম আলো