জাহেদ সরওয়ার সোহেল:
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মিষ্টি রোদ উঁকি দিচ্ছিলো কেবল। সমুদ্র শহরে একটি সাদা রংয়ের জীপ এলো, সাথে এলো কয়েকটি বাস। জীপের সামনে কয়েক রাতের নির্ঘুম লাল চোখ, শহরের বুক চিরে ছুটে চলা সাদা জীপটি থামলো কক্সাবাজার পাবলিক হল মাঠে।
গোল চত্বর ছিলো তখন। সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তোলা হলো লাল সবুজের পতাকা আর একজন মানুষ বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করলেন “আজ থেকে কক্সবাজার শত্রুমুক্ত”। সে মানুষটি আব্দুস সোবহান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আক্রমন চালালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত সুবেদার মেজর আব্দুস সোবহানসহ বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা বিদ্রোহ করে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সে সময় কালুরঘাট এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে বাম পা ও চোখে গুলি লাগে আব্দুস সোবাহানের। রক্তাক্ত অবস্থায়ও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। সেই আঘাতের চিহ্ন তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। বাম চোখে দেখতে পেতেন না, আর বাম পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতেন। পরে তাঁকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হলে সুস্থ হওয়ার পর এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে গেরিলা প্রশিক্ষন শুরু করেন।
বান্দরবান ও কক্সবাজার তৎকালীন এই দুই মহকুমার নাইক্ষংছড়ি, লামা, ঈদগড় এলাকায় মুক্তিসেনার ক্যাম্প গড়ে তোলেন।
এসময় ঈদগড়ের গহীন অরন্যে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে পাক সেনারা। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। যেখানে শহীদ হয় লাফ্রা মুরং নামের এক পাহাড়ী।
এরপর গেরিলা প্রশিক্ষন দিতে বার্মায় চলে যান তিনি, সেখান থেকে একদল মুক্তিবাহিনী নিয়ে ফের ফিরে এসে রামু থানাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সফল গেরিলা অপারেশন করেন।
ডিসেম্বরের ১২ তারিখ উখিয়ার পালং স্কুল ক্যাম্প থেকে সাদা জীপে করে কক্সবাজার শহরে আসেন আব্দুস সোবহান ও তাঁর অনুসারীরা। এরপর পাবলিক হলে মাঠে এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করার ঘোষনা দেন। যা লিপিবদ্ধ আছে স্বাধীনতার দলিল পত্রে।
দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার সেনাবাহিনীর চাকুরীতে ফিরে যান এবং ১৯৯১ সালে সেনাবাহিনীর অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর গ্রহন করেন। তাঁর লেখা “মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস” কাব্যগ্রন্থ ইতিহাসের প্রনিধানযোগ্য দলিলও বটে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ২ পুত্র ও ৪ কন্যার সন্তানের জনক। অবসরের পর থেকে তিনি হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যার নীজ বাড়িতেই কাঠিয়েছেন। নীজ এলাকায় নারী শিক্ষা বিস্তারে গড়ে তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
১২ জানুয়ারী ২০২৪, শুক্রবার রাত ৯ টায় নিজবাড়িতে ৮১ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান। তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন একাত্তুর, মাথা নত না করা সাহস, এ মাটির ঘ্রান বুকে নিয়ে জিতে যাওয়ার প্রেরনা। জন্মভূমি কক্সবাজারকে সেদিন বিকেলের আদ্রতায় দিয়েছিলো মুক্তির বার্তা । বিজয় এনেছিলো দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়ানোর উচ্ছ্বাসে।
জয় হে বীর। বীরের মৃত্যু নেই আছে রুপান্তর। Hero never dies…
লেখক- এডিটর-ইন-চীফ, টিটিএন।