বিশ্ব আদিবাসী দিবস বা International Day of the World’s Indigenous Peoples প্রতি বছর ৯ আগস্ট তারিখে পালিত হয়। এই দিবসটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার, সংস্কৃতি, এবং জীবনের মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। তবে এই দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি চলমান অবহেলা এবং তাদের অধিকারের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস।
প্রতি বছর ৯ আগস্ট, জাতিসংঘের উদ্যোগে সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। ১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া এই দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো—বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের জীবনসংগ্রাম, সংস্কৃতি ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা গড়ে তোলা। এই সচেতনতার বার্তা বহনের পাশাপাশি দিবসটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ রক্ষায় তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেও বিবেচিত হয়।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য: “আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ গঠন”—এই বার্তাটি প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে আনে এবং দেখায় কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ধারাকে সুরক্ষিত অথবা বিপন্ন করতে পারে। এটি এও নির্দেশ করে যে, এআই-চালিত ভবিষ্যৎ গঠনে আদিবাসী জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের প্রকৃতি আর আদিবাসীরাও একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্ব কল্পনা করারও কোনো সুযোগ নেই। আদিবাসী পরিবারে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই তার নিগূঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয় প্রকৃতির সঙ্গে। এ যেন হাজারও বছরের চিরাচরিত প্রকৃতির নিয়ম। তাদের চাষাবাদ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ওষুধপত্র, খাবার-দাবার, জ্বালানিসহ সব কিছু সংগ্রহ করেন প্রকৃতি থেকে।
বিশ্বের সব আদিবাসীর অধিকার, শত শত বছরের সমৃৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতি বছর গুরুত্বের সাথে দিবসটি পালন করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এবরিজিন, যুক্তরাষ্ট্রে রেড ইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডে মাউরি, দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকা ও মায়া, জাপানে আইনু, রাশিয়ায় মেনেট, ফ্রান্স ও স্পেনে বাসকু, আরবে বেদুইন আর বাংলাদেশে বিগত সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দকে পরিচয়ে স্পষ্ট না করে ৫০টি জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৫০ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (আদিবাসী) রয়েছেন। তারা হলেন –
রাখাইন
মারমা
ত্রিপুরা
গারো
চাকমা
সাঁওতাল
তঞ্চঙ্গ্যা
ম্রো
বম
খিয়াং
পাংখোয়া
মণিপুরি
ওঁরাও
হাজং
খাসিয়া
মুন্ডা
কোল
মাহাতো
বড়াইক
কুর্মি
সিং
পাহান
মাহালি
কোচ
শিয়াং
ধুমি
লুসাই
চাক
খেয়াং
পাংখোয়া
মগ
চাক
খুমী
হাজং
রাজবংশী
মাহালী
কন্দ
মালপাহারি
গঞ্জু
ডালু
কোচ
ওঁরাও
মাহাতো
বড়াইক
সিং
পাহান
কুর্মি
মুন্ডা
কোল
খাসি
আদিবাসীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের আদিবাসী নামের পক্ষে বিপক্ষে নানান যুক্তি রয়েছে বটে। তবে, সর্বাধিক স্বীকৃত আদিবাসী সংজ্ঞা হলো, ‘আদিবাসী শব্দের মূল বক্তব্য প্রান্তিকতায় যারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং এখনো প্রান্তিক অবস্থানে আছে। যারা আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে এবং এখনো নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি বিলুপ্ত প্রায় এবং যারা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অন্যের অধীনস্থ। আদিবাসীদের অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে যাদের সমাজ ব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, যা দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি হতে পৃথক। যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করে। ভূমির সঙ্গে যাদের নিবিড় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অধ্যাত্মিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে এবং যারা সাধারণভাবে মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে তারাই আদিবাসী।’
বিশ্বব্যাপী এই আদিবাসী দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হল-
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা এবং
বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের প্রতি বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা; সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ যেমন-
আদিবাসী সংস্কৃতি, ভাষা, এবং ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং তাদের সংরক্ষণে উৎসাহিত করা; আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করাসহ আদিবাসী জনগণের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম, এবং চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সমাজের অন্যান্য অংশের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
আসুন, আমরা সবাই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। এই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আসুন আমরা সবাই বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী যে মর্মান্তিক বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তা স্বীকার করে নিই এবং তাদের জ্ঞানকে সম্মান করতে সত্যিকারের সংহতি জানাই।
বিশ্বজুড়েই আদিবাসী জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান প্রান্তিকীকরণ, বৈষম্য ও বর্জনের শিকার হচ্ছে। এই সমস্যার শিকড় উপনিবেশিক, পুরুষতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক সমাজব্যবস্থার মানসিকতার কারণে। এই অসমতা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বড় বাধা হয়ে আছে।
আধুনিক ইতিহাস আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি ও এলাকা, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীকার, এমনকি তাদের সন্তানদেরও বঞ্চিত ও জিম্মি করে নেওয়ার ঘটনাসমূহ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। অযত্নে-অবহেলায় দিন দিন তাদের সংস্কৃতি ও ভাষাকে হেয় ও ধ্বংস করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব আবারও ঔপনিবেশিকদের হাতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিপীড়িত হওয়ার ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। কিছু দেশ ক্ষমাপ্রার্থনা, সত্য তুলে ধরা এবং পুনর্মিলন প্রচেষ্টা এবং আইনি ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এই ভয়াবহ প্রথা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। তবে আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন।
আমাদের নতুন বাংলাদেশের আগামীর নতুন সংবিধানে আদিবাসীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অংশগ্রহণের জন্য অংশিদারিত্বের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করবে এবং সেগুলো সম্মান করবে। আর এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিক আলোচনা, মিথষ্ক্রীয়া এবং কথা শোনার সদিচ্ছা। এই কাজ করতে আমাদের এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে, যার মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণা এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণা রয়েছে। এছাড়াও জাতীয় বিভিন্ন আইনেও আদিবাসী নামটি স্বীকৃতি অর্জন হয়েছে।
বিশ্বের ৪৭৬ মিলিয়ন অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাধীকার এবং সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের অবাধ, অগ্রাধিকারমূলক ও তথ্যপূর্ণ সম্মতিই মূল বিষয়।
তাই, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জ্ঞানের গুরত্ব, বিশেষত জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংকট নিরসন এবং সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে তাদের জ্ঞান, স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জ্ঞান তাদের নিজেদের মধ্যে বিতরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব আদিবাসী দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করার আহ্বান। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রা রক্ষা করার মাধ্যমে আমরা একটি ন্যায়সংগত ও সমান সমাজ গঠনের দিকে অগ্রসর হতে পারি। এই দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি। সমাজে কোন অংশ যাতে পিছিয়ে না থাকে এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্যও আদিবাসী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা অপরিসীম।
জাতিসংঘকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আজ এই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আসুন আমরা সবাই বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী যে মর্মান্তিক বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তা স্বীকার করে নিই এবং তাদের জ্ঞানকে সম্মান করতে সত্যিকারের সংহতি জানানো প্রতিটি নাগরিক এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
– মং এ খেন মংমং,
কবি, গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী
এবং সভাপতি, আদিবাসী কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা।