ঢাকা ১১:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পাবনায় ট্রাকচাপায় বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ নিহত ৩ কি হতে পারে: নির্বাচন, না নতুন অন্তর্বর্তী সরকার? ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে সড়ক ছাড়লো বাসটার্মিনাল এলাকার বাসিন্দারা টেকনাফ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক: দলীয় লেজুড়বৃত্তির সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন উখিয়ায় পুলিশের পৃথক অভিযানে মিলল ১০ হাজার ইয়াবা ওপার থেকে ছোড়া গুলি পায়ে বিঁধলো নারীর খুনিয়া পালংয়ে চলন্তগাড়িতে ফিল্মি কায়দায় ডা’কা’তি, মোবাইলও টাকা ছিনতাই চকরিয়ায় ফের ২ মোটরসাইকেল আরোহীর মৃ’ত্যু সেন্ট মার্টিন দখলকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা দিয়েছি: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উখিয়ায় ৮ খুদে হাফেজার কোরআন সবিনা খতম উপলক্ষে নানান আয়োজন বাবার সাথে মাছ ধরতে গিয়ে রেজুখালে স্কুল শিক্ষার্থী নিখোঁজ মহেশখালীর যুবদল নেতা রিয়াদ মোহাম্মদ আরফাতের অকাল মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদের শোক রামু বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে কঠিন চীবর দান সম্পন্ন বসতি বে রিসোর্টের সাথে লুৎফর রহমান কাজলের সম্পৃক্ততা নেই – কর্তৃপক্ষ নির্বাচনি জোট নিয়ে কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: আখতার
মন্তব্য কলাম

জুলাই সনদ: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নাকি নতুন দিগন্ত?

জুলাই সনদ; শব্দটা এখন রাজনীতির আড্ডায়, টকশোতে, এমনকি চায়ের দোকানেও উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি নাকি একটি ‘নতুন সূচনা’। আবার কেউ বলছে, ‘নতুন বোতলে পুরানো সুরা’। কয়েকটি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বসে এক টুকরো সাদা কাগজে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বলা হয়েছে; তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একমত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সনদটি আদৌ কী, এবং এর আইনি বা ঐতিহাসিক অবস্থান কোথায়?

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকে। সংবিধানের বাইরে কোনো ‘ইন্টারিম সরকার’ গঠনের পথ সেখানে নেই। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এমন কোনো ‘সনদ’ তৈরি করে, সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক অভিপ্রায় বা মতৈক্যের প্রতীক হতে পারে, কিন্তু সাংবিধানিক দলিল নয়। ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক অভিপ্রায় আর সাংবিধানিক বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান অনেক গভীর।

বিশ্ব ইতিহাসে ‘সনদ’ শব্দটি প্রথম গুরুত্ব পায় ১২১৫ সালের Magna Carta-তে, যখন ইংল্যান্ডের রাজা জন বাধ্য হন জনগণের কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকার করতে। সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক ভিত্তি পেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক ‘ঘোষণাপত্র’ বা ‘চুক্তি’ সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে, যেমন ১৯৭০-এর দশকে আফ্রিকার একাধিক মুক্তি আন্দোলনের ঘোষণা গুলো, বা মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু শান্তি-সনদ, যে গুলোর অনেকই শেষ পর্যন্ত কাগজেই থেকে গেছে।

বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি ‘মুক্তি চুক্তি’, ‘জাতীয় ঐক্য’, ‘মৈত্রী সনদ’ ইত্যাদি নানা রাজনৈতিক দলিলের জন্ম। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব দলিল বাস্তব ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন করতে পেরেছে। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই গণতন্ত্রের একমাত্র বৈধ উৎস। কাগজে লেখা; ইচ্ছা, নীতি বা আদর্শ যতই মহৎ হোক, সংবিধান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে ক্ষমতার কাঠামো সৃষ্টি করতে পারে না।

তবু, এই জুলাই সনদকে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। এটি অন্তত ইঙ্গিত দেয়, রাজনীতির ভেতরে এখনো সংলাপের সম্ভাবনা বেঁচে আছে। একটি রাজনৈতিক দল অন্য দলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, ভিন্ন অবস্থান থেকেও ‘একটি সাধারণ লক্ষ্য’ থাকতে পারে, এই মানসিকতাই রাজনীতির অক্সিজেন।

তবে সেই অক্সিজেনকে প্রজ্বলিত শিখায় পরিণত করতে হলে চাই জনগণের অংশগ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, এবং সর্বোপরি আইনি বৈধতা। নইলে এই সনদও হয়তো ইতিহাসের আরেকটি ‘অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া কাগজ’ হিসেবেই থেকে যাবে।

রাজনীতি কখনো সাদা কাগজের খেলা নয়। সেখানে প্রতিটি স্বাক্ষরের পেছনে জনগণের বিশ্বাস ও সময়ের বিচার লুকিয়ে থাকে। জুলাই সনদও সেই বিচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এটি কি নতুন দিগন্ত খুলবে, না কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক, লেখক ও চিন্তক

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

পাবনায় ট্রাকচাপায় বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ নিহত ৩

This will close in 6 seconds

মন্তব্য কলাম

জুলাই সনদ: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নাকি নতুন দিগন্ত?

আপডেট সময় : ০১:১৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

জুলাই সনদ; শব্দটা এখন রাজনীতির আড্ডায়, টকশোতে, এমনকি চায়ের দোকানেও উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি নাকি একটি ‘নতুন সূচনা’। আবার কেউ বলছে, ‘নতুন বোতলে পুরানো সুরা’। কয়েকটি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বসে এক টুকরো সাদা কাগজে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বলা হয়েছে; তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একমত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সনদটি আদৌ কী, এবং এর আইনি বা ঐতিহাসিক অবস্থান কোথায়?

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকে। সংবিধানের বাইরে কোনো ‘ইন্টারিম সরকার’ গঠনের পথ সেখানে নেই। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এমন কোনো ‘সনদ’ তৈরি করে, সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক অভিপ্রায় বা মতৈক্যের প্রতীক হতে পারে, কিন্তু সাংবিধানিক দলিল নয়। ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক অভিপ্রায় আর সাংবিধানিক বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান অনেক গভীর।

বিশ্ব ইতিহাসে ‘সনদ’ শব্দটি প্রথম গুরুত্ব পায় ১২১৫ সালের Magna Carta-তে, যখন ইংল্যান্ডের রাজা জন বাধ্য হন জনগণের কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকার করতে। সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক ভিত্তি পেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক ‘ঘোষণাপত্র’ বা ‘চুক্তি’ সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে, যেমন ১৯৭০-এর দশকে আফ্রিকার একাধিক মুক্তি আন্দোলনের ঘোষণা গুলো, বা মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু শান্তি-সনদ, যে গুলোর অনেকই শেষ পর্যন্ত কাগজেই থেকে গেছে।

বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি ‘মুক্তি চুক্তি’, ‘জাতীয় ঐক্য’, ‘মৈত্রী সনদ’ ইত্যাদি নানা রাজনৈতিক দলিলের জন্ম। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব দলিল বাস্তব ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন করতে পেরেছে। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই গণতন্ত্রের একমাত্র বৈধ উৎস। কাগজে লেখা; ইচ্ছা, নীতি বা আদর্শ যতই মহৎ হোক, সংবিধান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে ক্ষমতার কাঠামো সৃষ্টি করতে পারে না।

তবু, এই জুলাই সনদকে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। এটি অন্তত ইঙ্গিত দেয়, রাজনীতির ভেতরে এখনো সংলাপের সম্ভাবনা বেঁচে আছে। একটি রাজনৈতিক দল অন্য দলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, ভিন্ন অবস্থান থেকেও ‘একটি সাধারণ লক্ষ্য’ থাকতে পারে, এই মানসিকতাই রাজনীতির অক্সিজেন।

তবে সেই অক্সিজেনকে প্রজ্বলিত শিখায় পরিণত করতে হলে চাই জনগণের অংশগ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, এবং সর্বোপরি আইনি বৈধতা। নইলে এই সনদও হয়তো ইতিহাসের আরেকটি ‘অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া কাগজ’ হিসেবেই থেকে যাবে।

রাজনীতি কখনো সাদা কাগজের খেলা নয়। সেখানে প্রতিটি স্বাক্ষরের পেছনে জনগণের বিশ্বাস ও সময়ের বিচার লুকিয়ে থাকে। জুলাই সনদও সেই বিচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এটি কি নতুন দিগন্ত খুলবে, না কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক, লেখক ও চিন্তক