চন্দন ডাক্তার এক অদ্ভূত সরলপ্রাণ আর সমুদ্রবিস্তারি হৃদয়ের মানুষ। আমার যখন প্রচণ্ড দুর্দিন, আমার যখন রাজনীতি ও সংস্কৃতির ভূমিতে তির তির করে বেড়ে ওঠার সময়, চন্দন ডাক্তার, মানে আমাদের প্রিয়তম চন্দন দা ছিলেন অকৃত্রিম এক আশ্রয়। আমার জীবনে তাঁর মতো মানুষের সান্নিধ্যলাভ ছিল ইশ্বরের সান্নিধ্য লাভের সমান।
চন্দন দা এমন এক আত্মা, যে আত্মার মধ্যে আপনি পৃথিবীর সমস্ত চরাচরের সুখ এবং দুঃখকে স্পর্শ করতে পারবেন। মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-মত নির্বিশেষে ভালবাসার মতো পবিত্র অভ্যাস আমি উনার কাছ থেকে রপ্ত করেছিলাম। তাই চন্দন ডাক্তারের নাম মনে আসতেই আমার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠে, চোখ ভিজে আসে জলে।
মানুষ এত সুন্দর, এত নরম আর এত বিশ্ববিহারী কীভাবে হতে পারে, আমার প্রথম জানা হয়েছিল চন্দন দাকে দেখে। আজ থেকে অন্তত পঁচিশ বছর আগের কথা বলছি।
কক্সবাজার হাসপাতাল সড়কের সেই ছোট্ট পুরাতন চেম্বারটাতে চন্দন না রোজ বসতেন। খেলাঘর, সামাজিক নানা দায়িত্ব ও ফরমাশি কাজ সেরেও ক্লান্তিহীন দাদা যখন নিজের চেয়ারে চুপটি মেরে বসে, প্রসন্ন মনে, গুট গুট হাতে রোগীদের প্রেসক্রিপশন লিখতেন, আমার মনে হতো, শহরের সমস্ত নীরবতা ভর করতো তাঁর টেবিলে। সন্ধ্যাহ্নিকের ধূপের সুঘ্রাণ উনার চেম্বার ছাড়িয়ে সামনের প্যাসেজ, বারান্দা এমনকি উঠান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো। কক্সবাজার গেলে মাঝে মাঝেই আমি সেই ঘ্রাণ নিতে যেতাম, তার সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করে আসতাম।
সে ঘ্রাণ আজো পাচ্ছি আমি। এখনো মনে হয় ওই ঘ্রাণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন চন্দন না।
অপেক্ষারত রোগীদের ভীড় থেকে কোনো শিশুর কান্না ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে এগিয়ে যেতেন চন্দন দা। আজও সেই ধূপের গন্ধের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে চন্দন দা হয়তো শিশুর মাকে বলছেন—‘আহা, বাচ্চাটা কাঁদছে। আগেই কেন আনেননি ওকে?”
অথবা বলছেন হয়তো— “বাচ্চাদের জন্য সেরা ডাক্তার বাপ্পি দা। যান যান, দ্রুত উনার কাছে নিয়ে যান, আমি বলে দিচ্ছি…”
দাদা ছিলেন এলএমএএফ। একটা ফার্মেসি ছিল তাঁর। তার পাশে ছোট্ট চেম্বার দিয়ে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্সি করতেন। সবাই তাঁকে ডাক্তার বলেই ডাকতেন। চন্দন ডাক্তার এলএমএএফ হলেও লোকে বলতো এমবিবিএসের চেয়ে কম না। আমাদেরও বিশ্বাস, ভালবাসা আর নিজের পেশার প্রতি দরদই তাকে এমন লোকসম্মান এনে দিয়েছে। গরীবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি হয়েছে গোটা শহরে।
কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন দাদা। প্রার্থনা করছিলাম যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ফেরেন তিনি। কিন্তু সকালে দাদার মৃত্যুর খবর আমাকে এমন হতবিহ্বল করে দিল যে, মনে হলো আমি এক ভাইহারা ভাই সারা রাস্তা গড়িয়ে গড়িয়ে চিৎকার করছি আর বুক ভাসিয়ে কাঁদছি।
মাকে ফোন দিয়ে চন্দন দা’র মৃত্যুর খবর জানাতেই, মা খানিকক্ষণ চুপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আহা! ফেরেশতার মতো মানুষ! এমন অকালে চলে গেলো!!
তারপর একটু বিরতি দিয়ে আমাকে শান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন— তার জন্য দোয়া কর। হাজার মানুষের দোয়া আছে তার জন্য। আল্লাহ নিশ্চয় তাকে ফেরাবেন না।
আমি দাদার জন্য কী দোয়া করব? ভাইয়ের জন্য কী দোয়া করলে আল্লাহ তাকে কবুল করবেন, আমার জানা নাই…
লেখক- কবি, সাংবাদিক ও সংগঠক