ঢাকা ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পেকুয়ায় আগুনে পুড়লো ছয় বসতবাড়ি সিএনজির চাকায় পি’ষ্ট হয়ে মা’রা গেলো ১২ বছরের মোহাম্মদ সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত বৈঠক রামু সেনানিবাসে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হলো সশস্ত্র বাহিনী দিবস ঢাকায় বর্ষসেরা সাংবাদিকের সম্মাননা পেলেন কক্সবাজারের ইরফান বিজিবির ডগ “রকি” উদ্ধার করলো ৬০ হাজার ইয়াবা, যুবক আটক বাংলাদেশী ২৮ মাঝিমাল্লাসহ ফিশিং ট্রলার ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় কোস্টগার্ড ইট আর মাটিতে চাপা পড়ে নিভল ৬ প্রাণ, আহত শতাধিক ভূমিকম্পের পর প্রধান উপদেষ্টার বার্তা সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা ভূমিকম্পে যে ঝাঁকুনি হলো, তা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ: ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার ৫.৭ মাত্রার এমন ভূমিকম্প ‘আগে কখনো দেখেনি’ ঢাকা ভূমিকম্পে পুরান ঢাকায় নিহত ৩ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ব্যবসায়ীকে অ’পহ’রন: রোহিঙ্গা স’ন্ত্রা’সীদের সাথে এপিবিএনের ৬১ রাউন্ড গো’লাগু’লি যে ৪ বিষয়ে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে দোয়া করেছেন মহানবী (সা.)

আইনের আলোয় অন্ধকার বাস্তবতা: আয়োডিন ঘাটতির নীরব বিপদ

বাংলাদেশের উপকূলের সাদা মাঠে সূর্যের তাপে জমে ওঠা লবণ শুধু জীবিকার প্রতীক নয়, জনস্বাস্থ্যেরও এক অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই লবণই আজ জনস্বাস্থ্যের এক নীরব সংকটের মুখোমুখি করছে দেশকে। ২০২১ সালে প্রণীত “আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন” ছিল সেই সংকট মোকাবিলার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবুও বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, আইনের অগ্রগতি সত্ত্বেও আয়োডিনের অভাব এখনো বিস্তৃত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে লবণ প্রধানত দুই প্রকার; ভোজ্য লবণ ও শিল্প লবণ। ভোজ্য লবণে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে, যা মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। অপরদিকে শিল্প লবণ সাধারণত আয়োডিনবিহীন এবং ব্যবহৃত হয় চামড়া, টেক্সটাইল, ডিটারজেন্ট ও রাসায়নিক শিল্পে। কিন্তু নতুন আইনে বলা হয়েছে, শিল্পে ব্যবহৃত লবণেও আয়োডিন থাকতে হবে। অর্থাৎ দেশে আয়োডিনবিহীন লবণ উৎপাদন বা আমদানি এখন আইনত নিরুৎসাহিত।

তবুও মাঠপর্যায়ে চিত্রটি আশানুরূপ নয়। মিক্স৬ (২০১৯) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৩.৪ শতাংশ পরিবার এখনো আয়োডিনবিহীন লবণ ব্যবহার করছে, এবং ১৭.৬ শতাংশ পরিবার ব্যবহার করছে মাত্র ০–১৫ পিপিএম আয়োডিনযুক্ত লবণ। অথচ আইন বলছে, খুচরা পর্যায়ে লবণের আয়োডিনমাত্রা থাকতে হবে ২০–৩০ পিপিএম। অর্থাৎ, মোট ৪১ শতাংশ পরিবার এখনো শুন্য আয়োডিন পাচ্ছে অথবা মানসম্মত আয়োডিন পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (SVRS ২০২৩) অনুসারে, গড়ে প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য থাকায় মোট পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার। এর ৪১ শতাংশ পরিবার, অর্থাৎ ১ কোটি ৪১ লাখ ৭৯ হাজার পরিবারেরও বেশি, প্রায় ৭ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত আয়োডিন পাচ্ছে না। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার ভাষা নয়, এটি জাতীয় জনস্বাস্থ্যের একটি গভীর সতর্কবার্তা।

২০২২ সালের এপ্রিলে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে পরিচালিত এক শুমারিতে ৯৭৭ জন প্রকৃত লবণ চাষি নিবন্ধিত হন। তাদের মধ্যে ২৯টি প্রশ্ন নিয়ে করা এক জরিপে দেখা যায়, ৯১.৭২ শতাংশ চাষি মাঠের খোলা লবণ ব্যবহার করেন, এবং মাত্র ৭.৮৮ শতাংশ চাষি প্যাকেট জাত আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করেন। খোলা লবণে প্রাকৃতিকভাবে আয়োডিন থাকে না। ফলে এই কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০১৯ সালের পর প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এই চিত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি।

আয়োডিনের অভাব শুধু একটি পুষ্টি ঘাটতি নয়, এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর ফলে হতে পারে গলগণ্ড, শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, ক্রিটিনিজম ও মাতৃ-শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধি। অথচ এই সমস্যার সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান হলো, লবণ আয়োডিনাইজেশন। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি সফল জনস্বাস্থ্য কৌশল।

আইন থাকার পরও কেন বাস্তবায়ন দুর্বল, তার উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা এবং তদারকির ঘাটতি রয়েছে। আয়োডিন টেস্টিং ল্যাবের স্বল্পতা, মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণের অভাব, বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার ঘাটতি, সব মিলিয়ে নীতিগত সাফল্য কার্যকর বাস্তবতায় পরিণত হতে পারছে না। অথচ আইন যতই কঠোর হোক, যদি তার বাস্তবায়ন দুর্বল হয়, তবে তা জনগণের কাছে অর্থহীন থেকে যায়।

উপকূলের মাঠে লবণ তুলে নেওয়া সেই কৃষকই দেশের আয়োডিন নিরাপত্তার প্রথম প্রহরী। তার হাতে তোলা লবণের প্রতিটি দানা যেন আয়োডিনযুক্ত স্বাস্থ্য প্রতিশ্রুতির প্রতীক হয়, এই লক্ষ্যেই আইন প্রণয়ন হয়েছে। এখন প্রয়োজন সেই আইনের সুফলকে মাঠে পৌঁছে দেওয়া।

কারণ, আয়োডিনবিহীন লবণের প্রতিটি কণাই একেকটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর আয়োডিনযুক্ত লবণের প্রতিটি দানাই একটি সুস্থ, বুদ্ধিদীপ্ত ও কর্মক্ষম জাতির বিনিয়োগ।

লেখক-শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক,গবেষক ও চিন্তক

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

This will close in 6 seconds

আইনের আলোয় অন্ধকার বাস্তবতা: আয়োডিন ঘাটতির নীরব বিপদ

আপডেট সময় : ১১:৫৭:২২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের উপকূলের সাদা মাঠে সূর্যের তাপে জমে ওঠা লবণ শুধু জীবিকার প্রতীক নয়, জনস্বাস্থ্যেরও এক অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই লবণই আজ জনস্বাস্থ্যের এক নীরব সংকটের মুখোমুখি করছে দেশকে। ২০২১ সালে প্রণীত “আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন” ছিল সেই সংকট মোকাবিলার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবুও বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, আইনের অগ্রগতি সত্ত্বেও আয়োডিনের অভাব এখনো বিস্তৃত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে লবণ প্রধানত দুই প্রকার; ভোজ্য লবণ ও শিল্প লবণ। ভোজ্য লবণে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে, যা মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। অপরদিকে শিল্প লবণ সাধারণত আয়োডিনবিহীন এবং ব্যবহৃত হয় চামড়া, টেক্সটাইল, ডিটারজেন্ট ও রাসায়নিক শিল্পে। কিন্তু নতুন আইনে বলা হয়েছে, শিল্পে ব্যবহৃত লবণেও আয়োডিন থাকতে হবে। অর্থাৎ দেশে আয়োডিনবিহীন লবণ উৎপাদন বা আমদানি এখন আইনত নিরুৎসাহিত।

তবুও মাঠপর্যায়ে চিত্রটি আশানুরূপ নয়। মিক্স৬ (২০১৯) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৩.৪ শতাংশ পরিবার এখনো আয়োডিনবিহীন লবণ ব্যবহার করছে, এবং ১৭.৬ শতাংশ পরিবার ব্যবহার করছে মাত্র ০–১৫ পিপিএম আয়োডিনযুক্ত লবণ। অথচ আইন বলছে, খুচরা পর্যায়ে লবণের আয়োডিনমাত্রা থাকতে হবে ২০–৩০ পিপিএম। অর্থাৎ, মোট ৪১ শতাংশ পরিবার এখনো শুন্য আয়োডিন পাচ্ছে অথবা মানসম্মত আয়োডিন পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (SVRS ২০২৩) অনুসারে, গড়ে প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য থাকায় মোট পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার। এর ৪১ শতাংশ পরিবার, অর্থাৎ ১ কোটি ৪১ লাখ ৭৯ হাজার পরিবারেরও বেশি, প্রায় ৭ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত আয়োডিন পাচ্ছে না। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার ভাষা নয়, এটি জাতীয় জনস্বাস্থ্যের একটি গভীর সতর্কবার্তা।

২০২২ সালের এপ্রিলে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে পরিচালিত এক শুমারিতে ৯৭৭ জন প্রকৃত লবণ চাষি নিবন্ধিত হন। তাদের মধ্যে ২৯টি প্রশ্ন নিয়ে করা এক জরিপে দেখা যায়, ৯১.৭২ শতাংশ চাষি মাঠের খোলা লবণ ব্যবহার করেন, এবং মাত্র ৭.৮৮ শতাংশ চাষি প্যাকেট জাত আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করেন। খোলা লবণে প্রাকৃতিকভাবে আয়োডিন থাকে না। ফলে এই কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০১৯ সালের পর প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এই চিত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি।

আয়োডিনের অভাব শুধু একটি পুষ্টি ঘাটতি নয়, এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর ফলে হতে পারে গলগণ্ড, শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, ক্রিটিনিজম ও মাতৃ-শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধি। অথচ এই সমস্যার সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান হলো, লবণ আয়োডিনাইজেশন। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি সফল জনস্বাস্থ্য কৌশল।

আইন থাকার পরও কেন বাস্তবায়ন দুর্বল, তার উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা এবং তদারকির ঘাটতি রয়েছে। আয়োডিন টেস্টিং ল্যাবের স্বল্পতা, মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণের অভাব, বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার ঘাটতি, সব মিলিয়ে নীতিগত সাফল্য কার্যকর বাস্তবতায় পরিণত হতে পারছে না। অথচ আইন যতই কঠোর হোক, যদি তার বাস্তবায়ন দুর্বল হয়, তবে তা জনগণের কাছে অর্থহীন থেকে যায়।

উপকূলের মাঠে লবণ তুলে নেওয়া সেই কৃষকই দেশের আয়োডিন নিরাপত্তার প্রথম প্রহরী। তার হাতে তোলা লবণের প্রতিটি দানা যেন আয়োডিনযুক্ত স্বাস্থ্য প্রতিশ্রুতির প্রতীক হয়, এই লক্ষ্যেই আইন প্রণয়ন হয়েছে। এখন প্রয়োজন সেই আইনের সুফলকে মাঠে পৌঁছে দেওয়া।

কারণ, আয়োডিনবিহীন লবণের প্রতিটি কণাই একেকটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর আয়োডিনযুক্ত লবণের প্রতিটি দানাই একটি সুস্থ, বুদ্ধিদীপ্ত ও কর্মক্ষম জাতির বিনিয়োগ।

লেখক-শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক,গবেষক ও চিন্তক