বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক জেলে জলসীমা অতিক্রম করায় ভারতের কোস্ট গার্ড তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় বলে স্বজনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
এর মধ্যে ভারতের কারাগার থেকে কেউ কেউ পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছেন। নিখোঁজ জেলেদের বেঁচে থাকার খবর পেয়ে পরিবারে স্বস্তি ফিরেছে।
অপরদিকে কেউ কেউ ‘লোক মারফত’ জানতে পেরেছে যে, তাদের পরিবারের সদস্যরা ভারতের কোস্ট গার্ডের হাতের গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
১০ নভেম্বর ভোলার লালমোহন উপজেলার ১৩ জেলে, ১৯ নভেম্বর কুতুবদিয়ার ২৮ জেলে, একই দিন কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীর ২৬ জেলে এবং সবশেষ ৩০ নভেম্বর কুতুবদিয়ার আরও ১৫ জেলে ভারতের কোস্ট গার্ড গ্রেপ্তার করেছে স্বজনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীর জেলেরা দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বাংলাদেশি জেলেদের গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের কোস্ট গার্ড ও প্রশাসনিক পর্যায়ে বৈঠক ও আলোচনার মধ্য দিয়ে বন্দি জেলেরা নিজেদের দেশে ফিরেছেন।
ছেলের মুখ দেখতে চান মা
প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করেই কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দাদের অন্যতম প্রধান উৎস বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা। বৈরি আবহাওয়ায় অনেক সময় জেলেদের ট্রলার জলসীমা অতিক্রম করে ভারতের অংশে চলে যায়। তখন তাদের আটক করে ভারতীয় কোস্ট গার্ড।
গত দুই সপ্তাহে এমন ঘটনায় ভারতের কারাগারে বন্দি হয়েছেন কুতুবদিয়ার অন্তত ৫৬ জেলে। তাদের নিয়ে চরম উদ্বেগে আছেন পরিবারের সদস্যরা। অনেক জেলেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই দ্রুত স্বজনদের ফেরাতে প্রশাসনের উদ্যোগ চান জেলেপল্লীর বাসিন্দারা।
৩০ নভেম্বর (রোববার)১৪ সহকর্মীর সঙ্গে ভারতীয় কোস্ট গার্ডের হাতে গ্রেপ্তার হন শিপঙ্কর দাশ। তিনি পরিবারের একমাত্র ভরসা। সংসারের বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর ঘরের দায়িত্ব ছিল তার ওপর।
তার মা নয়ন রানী দাশ বলেন, “সে আমাদের ছয়জনকে সামলাত… জানি না কবে ছেলের মুখটা দেখতে পাব।”
আরেক জেলে বেণু বাঁশি জলদাশের স্ত্রী বিপু রানী জলদাশ স্বামী আটকের খবরে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলছিলেন, “স্বামী ছাড়া ঘরটা অন্ধকার। সে অসুস্থ ছিল, তারপরও পরিবারের জন্য সাগরে গেছে।”
১৯ নভেম্বর আটক হওয়া জেলে এনামুল হকের বাবা মোহাম্মদ রফিক বলেন, “আমাদের পেটের খোরাক যোগাতেই তারা সাগরে গেছে। সরকার চাইলে তাদের ফেরাতে পারে।”
ছেলেসহ সব জেলেকে দ্রুত ফেরানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের অনুরোধও জানিয়েছেন এই বৃদ্ধ।
৩০ নভেম্বর ভারতীয় গণমাধ্যম দি হিন্দুর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে অভিযান চালিয়ে কুতুবদিয়া থেকে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া ‘এমবি আল্লাহ মালিক’ ট্রলারটি আটক করেছে ভারতীয় কোস্ট গার্ড।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ অভিযোগে ট্রলারসহ জেলেদের ফ্রেজারগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আটক হওয়া ১৫ জেলে হলেন- আব্দুর রাজ্জাক, বেণু বাঁশি জলদাশ, ফয়েজ, মোস্তাক আহম্মদ, নাজিম উদ্দীন, সর্বানন্দ জল দাশ, সম্রাজ দাশ, মো. কাইছার, নিবজল দাশ, আব্দুস ছালাম, আইয়ুব খান, আব্দুল আলিম, শিপংকর দাশ, শামীম উদ্দিন ও লিবজল দাশ।
এর আগে ১৯ নভেম্বর কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিলের নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন একটি ট্রলার সমুদ্রে কুয়াশায় পথ হারালে ২৮ জেলেসহ সেটি আটক করে ভারতীয় কোস্ট গার্ড।
নজরুল ইসলাম বলেন, “কুয়াশার কারণে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়ে। পরে তাদেরকে ভারতীয় কোস্ট গার্ড গ্রেপ্তার করে।”
কীভাবে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন জানতে চাইলে ট্রলার মালিক নজরুল বলেন, “আটক হওয়া আমার ট্রলারের মাঝি ভারতীয় কোস্ট গার্ডের এক সদস্যের মোবাইল থেকে কুতুবদিয়ার এক মাঝিকে ফোন করে জানান। আমার মাঝি তাকে বলেছে, তারা সবাই আটক হয়েছে। তাদের জাল সাগরের কোন জায়গায় ফেলা আছে সেটাও বলেছে। কোম্পানি (ট্রলার মালিক) যেন সেখান থেকে জালটি সংগ্রহ করে।”
সে ট্রলারটিতে ছিলেন- দক্ষিণ ধূরুং ইউনিয়নের জসিম উদ্দিন, নুরুল বশর,মোহাম্মদ শাহিন, তারেক মুহাম্মদ নওশাদ, আতিকুর রহমান, শাহাব উদ্দিন, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, মোহাম্মদ রাকিব, মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, নুরুল ইসলাম, জোবাইদুল হক, আলী আকবর।
ডেইল ইউনিয়নের জকির আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ তুহিন আলম, মোহাম্মদ মোজাহেদ, শাহেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আজিজুর রহমান।
উত্তর ধূরুং ইউনিয়নের হাফিজুর রহমান, আবুল বশর, মোহাম্মদ নাজেম উদ্দিন, এনামুল হক, মোহাম্মদ শরীফ, রবিউল হাছান।
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ওমর ফারুক, মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, আকতার হোছাইন, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী।
একইদিন আরেক ঘটনায় মাঝসাগরে ইঞ্জিন বিকল হলে পথ হারিয়ে ভারতের দিকে চলে যায় বাঁশখালীর জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন ‘এমভি মায়ের দোয়া’ ট্রলারটি। এই ট্রলারে ছিলেন ২৬ জেলে, যার মধ্যে কুতুবদিয়ার ১৩ জন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আটক জেলেদের ফ্রেজারগঞ্জ পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয় এবং পরে আদালতের নির্দেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
কুতুবদিয়ার জেলেরা হলেন, ছৈয়দ নুর, মামুনুর রশীদ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মো. মারুফুল ইসলাম, মো. মিরাজ উদ্দিন, মো. ফারুক, মো. একরাম, শওকত আলম, সরওয়ার হোছাইন, আজিজ হোসাইন, নুর মোহাম্মদ, আবু তাহের ও রেজাউল করিম।
প্রশাসনের তৎপরতা
তবে আশার কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে আটক জেলেদের ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ভারত ৯০ জন বাংলাদেশি জেলেকে ফেরত দিয়েছিল। একই দিন বাংলাদেশও ৯৫ ভারতীয় জেলেকে তাদের কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করেছে।
সম্প্রতি আটকদের নিয়ে দক্ষিণ ধূরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, “উপজেলা প্রশাসনের কাছে সব আটকদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। পরিবারগুলো কষ্টে আছে, আমরা চাই তারা দ্রুত দেশে ফিরুক।”
কুতুবদিয়ার ইউএনও ক্যথোয়াইপ্রু মারমা বলেন, “আটকদের পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করা হয়েছে; প্রক্রিয়া এগোচ্ছে।”
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান বলেন, কুতুবদিয়া গিয়ে তিনি সম্প্রতি কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “পরিবারগুলোর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি, জেলেদের ফেরাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।”
পরিবারের কাছে ১৩ জেলের ফোন
এদিকে ২১ দিন নিখোঁজ থাকার পর ভোলার লালমোহন উপজেলার ১৩ জেলের সন্ধান পেয়েছে পরিবার। সোমবার এই জেলেরা ভারতের কারাগার থেকে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
১৩ জেলের জীবিত থাকার খবরে বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে পরিবারগুলোতে। তবে সরকারের কাছে জেলেদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
স্বজনরা জানান, ১০ নভেম্বর উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাতিরখাল মৎস্যঘাট এলাকা থেকে ১৩ জেলে সাগরে মাছ শিকারের যাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ভারতের কারাগারে থাকা জেলেরা হলেন- লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের দলিল মাস্টার বাজার এলাকার মো. মাকসুদুর রহমান, মো. খোকন, মো. হেলাল, মো. শামিম, মো. সাব্বির, মো. সজিব, মো. জাহাঙ্গীর, মো. নাছির মাঝি, একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাতিরখাল এলাকার আব্দুল মালেক, মো. ফারুক, মো. মাকসুদ, মো. আলম মাঝি ও মো. ফারুক।
জেলে মো. হেলালের স্ত্রী মিতু বেগম বলেন, “সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার পর থেকেই আমার স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। ২১ দিন পর ভারত থেকে আমার স্বামী ইমুতে কল দিয়েছে। বলেছেন, তারা সবাই সেখানের একটি কারাগারে আছেন। সবাই এখনো বেঁচে থাকায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এখন তাদেরকে আমাদের কাছে এনে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।”
ধলীগৌরনগর ইউনিয়ন পশ্চিম শাখা বিএনপির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন নসু বলেন, “জেলেদের পরিবার এতদিন অত্যন্ত শোকের ভেতর ছিলেন। তারা স্বজনদের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবে তাদের সেই দুশ্চিন্তা এখন দূর হয়েছে।
“সোমবার ভারতের একটি কারাগার থেকে তারা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাই ওইসব পরিবারের পক্ষ থেকে আমি সরকারের কাছে দাবি করছি; যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেন ভারতে থাকা ওইসব জেলেদের ফিরিয়ে আনা হয়।”
এ বিষয়ে লালমোহন থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা ধারণা করছি, সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়ে ভারতের জলসীমায় ঢুকে পড়েন জেলেরা। এরপর তাদের ভারতের নৌবাহিনীর সদস্যরা আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে।
“তারা পশ্চিমবঙ্গের একটি কারাগারে রয়েছেন। এখন আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাব। এরপর কর্তৃপক্ষ ভারতে থাকা ওইসব জেলেদের দেশে ফিরিয়ে আনার যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে তার মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।”
সূত্র: বিডিনিউজ
টিটিএন ডেস্ক: 

























