ঢাকা ০৯:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পেকুয়ায় আগুনে পুড়লো ছয় বসতবাড়ি সিএনজির চাকায় পি’ষ্ট হয়ে মা’রা গেলো ১২ বছরের মোহাম্মদ সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত বৈঠক রামু সেনানিবাসে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হলো সশস্ত্র বাহিনী দিবস ঢাকায় বর্ষসেরা সাংবাদিকের সম্মাননা পেলেন কক্সবাজারের ইরফান বিজিবির ডগ “রকি” উদ্ধার করলো ৬০ হাজার ইয়াবা, যুবক আটক বাংলাদেশী ২৮ মাঝিমাল্লাসহ ফিশিং ট্রলার ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় কোস্টগার্ড ইট আর মাটিতে চাপা পড়ে নিভল ৬ প্রাণ, আহত শতাধিক ভূমিকম্পের পর প্রধান উপদেষ্টার বার্তা সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা ভূমিকম্পে যে ঝাঁকুনি হলো, তা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ: ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার ৫.৭ মাত্রার এমন ভূমিকম্প ‘আগে কখনো দেখেনি’ ঢাকা ভূমিকম্পে পুরান ঢাকায় নিহত ৩ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ব্যবসায়ীকে অ’পহ’রন: রোহিঙ্গা স’ন্ত্রা’সীদের সাথে এপিবিএনের ৬১ রাউন্ড গো’লাগু’লি যে ৪ বিষয়ে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে দোয়া করেছেন মহানবী (সা.)
আজ বিশ্ব শিশু দিবস

শিশুদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ বাংলাদেশ

  • টিটিএন ডেস্ক:
  • আপডেট সময় : ১২:৫২:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
  • 64

ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশের শিশুরা(ছবি: সংগৃহিত)

আজ বিশ্ব শিশু দিবস। বিশ্বজুড়ে শিশুর অধিকার সুরক্ষায় ১৯৮৯ সালের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার কনভেনশন বা সনদ (সিআরসি) গৃহীত হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এ বছরও দিবসটি পালনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ এক গভীরতর শিশু-অধিকার সংকটের মধ্যে রয়েছে। নতুন প্রকাশিত জাতীয় তথ্য বলছে—শিশুদের মধ্যে বিষাক্ত ধাতুর সংক্রমণ, শিশুশ্রম, নিরাপদ পানি সংকট ও অপুষ্টির হার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। হাজার হাজার শিশু এখনও প্রতিদিন অনিরাপদ অবস্থায় ঢাকার রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে।

ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫ -এর প্রাথমিক তথ্য বলছে—দেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও শিশুদের বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নির্ধারণী বহুক্ষেত্রে গুরুতরভাবে পিছিয়ে পড়ছে।

বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শ

এমআইসিএস জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের পর থেকে ৬ বছরে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ১২ লাখ শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। একইসঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় প্রতি দশে চারজনের রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে। ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে, বাল্যবিবাহ ও নবজাতক মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও পুরোনো ও নতুন কিছু ঝুঁকির সমন্বয় “লাখো শিশুর ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছে।”

এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “এটি একইসঙ্গে আশা ও গভীর উদ্বেগের সময়। বাল্যবিবাহ ও শিশু মৃত্যুহার কমার মাধ্যমে আমরা ইতিবাচক সাফল্য দেখছি; কিন্তু সীসাদূষণ, সি-সেকশন বৃদ্ধি ও শিশুশ্রমের বিস্তার জাতির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে।”

দেশজুড়ে প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা এই জরিপে দেখা গেছে ১২–৫৯ মাস বয়সী ৩৮ শতাংশ শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের ৮ শতাংশের রক্তে নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে সিসা রয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ঢাকায়, ৬৫ শতাংশ শিশু সিসা দূষণের শিকার। অবাক করার মতো বিষয় হলো—ধনী পরিবারের শিশুদের মধ্যে সিসা-সংস্পর্শের হার সর্বোচ্চ; ঢাকায় আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী শ্রেণির।

এ বিষয়ে ফ্লাওয়ার্স বলেন, “প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিস—কসমেটিকস, বাসন, খেলনা—শিশুদের বিষাক্ত করছে।”

গবেষণায় স্থানীয়ভাবে তৈরি কিছু কাজলের নমুনায় ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত সিসা পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সিসার সংস্পর্শে শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি, আইকিউ কমে যাওয়া ও জাতীয় উৎপাদনশীলতায় প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।

শিশুশ্রম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে

সিসা দূষণের পাশাপাশি শিশুশ্রমেও উদ্বেগজনক উর্ধ্বগতি দেখা গেছে এমআইসিএস জরিপে।

২০১৯ সালের ৬ দশকি ৮ শতাংশ থেকে শিশুশ্রম বেড়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আরও ১০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে।

বাড়ির ভেতর সহিংসতার মাত্রা একইভাবে ভয়াবহ। ৮৬ শতাংশ শিশু কোনও না কোনও ধরনের সহিংস শাসনের শিকার, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।

বালবিবাহ ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশ হলেও এখনও প্রায় অর্ধেক কন্যাশিশুর বিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই হয়ে যায়।

জন্ম নিবন্ধনের হার এখনও কম, মাত্র ৫৯ শতাংশ; যা শিশুদের মৌলিক অধিকার ও সেবায় প্রবেশাধিকার সীমিত করে।

মনোবিজ্ঞানী কাজী রুমানা হক বলেন, “এমন পরিবেশে বড় হওয়া শিশু ‘নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখাই বন্ধ করে দেয়।” দারিদ্র্য, অপবাদ ও সহায়তার অভাব তাদের অনেককে মাদক, শোষণ বা অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আবু আহমেদ ফাইজুল কবীর বলেন, “যদি আইনপ্রয়োগ, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী না করা হয়, তবে বাংলাদেশ একটি পুরো প্রজন্মকে শোষণের কাছে হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।”

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য

এমআইসিএস জরিপের তথ্য বলছে—অগ্রগতি ও পশ্চাদপসরণের এক জটিল মিশ্রণ এখন বাংলাদেশে দৃশ্যমান। শিশু অপুষ্টির ‘ওয়েস্টিং’ হার ২০১৯ সালের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে।

মায়েদের মধ্যে অ্যানিমিয়ার হার ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ।

কিশোরী মাতৃত্বের হার বেড়ে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৯২ জনে পৌঁছেছে। এসব কিশোরী মায়েদের নবজাতক জীবীতের হার প্রতি হাজোরে মাত্র ২২।

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রসবের মধ্যে এখন ৭৫ শতাংশের বেশি সি-সেকশন, যা চিকিৎসা-পরামর্শের অভাব ও অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

ফ্লাওয়ার্স জানান, জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ শতাংশ মেয়ে প্রথমবার মাসিক শুরু হওয়ার সময় বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানত না; এটি কিশোরীদের স্বাস্থ্য জ্ঞানে উদ্বেগজনক ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

স্যানিটেশন কাভারেজ ৭৩ শতাংশে উন্নীত হলেও নিরাপদভাবে ব্যবস্থাপিত পানির প্রাপ্যতা কমে ৩৯.৩% হয়েছে—ফলে ১০ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ দূষিত উৎসের ওপর নির্ভর করছে।

জরিপে দেখা গেছে—প্রায় অর্ধেক পানির উৎস ও ৮০ শতাংশের বেশি বাড়ির পানি নমুনায় ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

জলবায়ুজনিত দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা গতবছর ১০ শতাংশের বেশি পানিসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যা সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার প্রায় ৮০ শতাংশ হলেও মাধ্যমিকে তা দ্রুত কমে যায়।

শেখার ফলাফল এখনও দুর্বল—অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মৌলিক পড়া বা গণিত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।

ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে—শিশুশ্রম ও শেখার ঘাটতির মিলিত প্রভাব দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে “পারফেক্ট স্টর্ম” তৈরি করছে।

ঢাকার রাস্তায় সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা

জাতীয় তথ্যের বাইরেও ঢাকার বাস্তবতা আরও ভীতিকর।

সরেজমিনে এক রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে—ফ্লাইওভার, ফুটপাত, বাজারের পাশে, ব্যস্ত মোড়ে হাজারের বেশি বেশি শিশু ঘুমাতে দেখা গেছে।

ফার্মগেটের খামারবাড়ি মোড়ে রাত ৪টায় ৩০ জনের বেশি শিশু ও পরিবারকে ফুটপাত ঘুমাতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে তিন মাস বয়সী শিশুও দেখা গেছে।

তাদের মধ্যে অনেক শিশু স্পষ্টতই অপুষ্ট; অনেকে নিয়মিত নেশা করার কথাও স্বীকার করেছে।

পুলিশ জানায়—একই শিশুদের বারবার আটক করলেও তাদের জন্য কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।

এক পুলিশ সদস্য জানান—একজন আটক শিশুরা হেফাজতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল; পুলিশ জানত না তাকে কোথায় পাঠানো উচিত বা কীভাবে সহায়তা দিতে হবে।

সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বাজেট থাকা সত্ত্বেও ভয়াবহভাবে অব্যবহৃত। ৩৫ শিশু ধারণক্ষমতার কামরালপুর কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা গেছে—মাত্র সাতজন শিশু রয়েছে।

পরিচ্ছন্নতা, তদারকি ও মৌলিক সেবা—সবকিছুরই ঘাটতি দেখা গেছে সেখানে। সদরঘাট আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা গেছে—কোনও কর্মী ছাড়াই শিশুরা নদীতে গোসল করছে।

এনজিও বলছেন—রাষ্ট্রীয় সেবা মারাত্মকভাবে অপ্রতুল; হালনাগাদ তথ্য নেই, সমন্বয় নেই, শিশু-বান্ধব পরিবেশ নেই।

বেসরকারি সংস্থা লিডোর নির্বাহী পরিচালক বলেন, “এই শিশুরাই জাতির সম্পদ। রাষ্ট্র ও এনজিওদের শক্তিশালী সমন্বয় না হলে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।”

গবেষণা বলছে—বাংলাদেশে ৩৪ লাখ শিশু রাস্তা-ভিত্তিক পরিবেশে বড় হচ্ছে—হয়রানি, সহিংসতা, আবহাওয়ার ঝুঁকি ও শোষণের পুরোপুরি মুখোমুখি হয়ে।

বাংলাদেশের জন্য এক এমন সময়, যা এড়ানো যাবে না

সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—হটলাইন, আশ্রয়কেন্দ্র ও সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে; তবে দক্ষ জনবল ঘাটতি ও দুর্বল মনিটরিংয়ের বিষয়টিও স্বীকার করেছে তারা।

এদিকে এসডিসি, মার্কিন সরকার, ইউএনএইচসিআর, ইউএনএফপিএ ও আইইডিসিআরসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিকস তথ্য অনুযায়ী জরুরি নীতি পদক্ষেপে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে—বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। শিশুশ্রম, সিসাদূষণ, অপুষ্টি ও নিরাপদ পানি সংকট ইতোমধ্যে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনছে।

এ প্রসঙ্গে ফ্লাওয়ার্স বলেন, “আমরা এখনও প্রতিটি শিশুর বাঁচা, বেড়ে ওঠা ও শেখার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না। বাংলাদেশকে এখনই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে; অন্যথায় লাখ লাখ শিশুকে পেছনে ফেলে উন্নত-আয়ের দেশের পথে এগোনো সম্ভব হবে না।”

সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

This will close in 6 seconds

আজ বিশ্ব শিশু দিবস

শিশুদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ১২:৫২:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

আজ বিশ্ব শিশু দিবস। বিশ্বজুড়ে শিশুর অধিকার সুরক্ষায় ১৯৮৯ সালের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার কনভেনশন বা সনদ (সিআরসি) গৃহীত হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এ বছরও দিবসটি পালনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ এক গভীরতর শিশু-অধিকার সংকটের মধ্যে রয়েছে। নতুন প্রকাশিত জাতীয় তথ্য বলছে—শিশুদের মধ্যে বিষাক্ত ধাতুর সংক্রমণ, শিশুশ্রম, নিরাপদ পানি সংকট ও অপুষ্টির হার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। হাজার হাজার শিশু এখনও প্রতিদিন অনিরাপদ অবস্থায় ঢাকার রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে।

ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫ -এর প্রাথমিক তথ্য বলছে—দেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও শিশুদের বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নির্ধারণী বহুক্ষেত্রে গুরুতরভাবে পিছিয়ে পড়ছে।

বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শ

এমআইসিএস জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের পর থেকে ৬ বছরে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ১২ লাখ শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। একইসঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় প্রতি দশে চারজনের রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে। ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে, বাল্যবিবাহ ও নবজাতক মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও পুরোনো ও নতুন কিছু ঝুঁকির সমন্বয় “লাখো শিশুর ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছে।”

এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “এটি একইসঙ্গে আশা ও গভীর উদ্বেগের সময়। বাল্যবিবাহ ও শিশু মৃত্যুহার কমার মাধ্যমে আমরা ইতিবাচক সাফল্য দেখছি; কিন্তু সীসাদূষণ, সি-সেকশন বৃদ্ধি ও শিশুশ্রমের বিস্তার জাতির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে।”

দেশজুড়ে প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা এই জরিপে দেখা গেছে ১২–৫৯ মাস বয়সী ৩৮ শতাংশ শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের ৮ শতাংশের রক্তে নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে সিসা রয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ঢাকায়, ৬৫ শতাংশ শিশু সিসা দূষণের শিকার। অবাক করার মতো বিষয় হলো—ধনী পরিবারের শিশুদের মধ্যে সিসা-সংস্পর্শের হার সর্বোচ্চ; ঢাকায় আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী শ্রেণির।

এ বিষয়ে ফ্লাওয়ার্স বলেন, “প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিস—কসমেটিকস, বাসন, খেলনা—শিশুদের বিষাক্ত করছে।”

গবেষণায় স্থানীয়ভাবে তৈরি কিছু কাজলের নমুনায় ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত সিসা পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সিসার সংস্পর্শে শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি, আইকিউ কমে যাওয়া ও জাতীয় উৎপাদনশীলতায় প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।

শিশুশ্রম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে

সিসা দূষণের পাশাপাশি শিশুশ্রমেও উদ্বেগজনক উর্ধ্বগতি দেখা গেছে এমআইসিএস জরিপে।

২০১৯ সালের ৬ দশকি ৮ শতাংশ থেকে শিশুশ্রম বেড়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আরও ১০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে।

বাড়ির ভেতর সহিংসতার মাত্রা একইভাবে ভয়াবহ। ৮৬ শতাংশ শিশু কোনও না কোনও ধরনের সহিংস শাসনের শিকার, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।

বালবিবাহ ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশ হলেও এখনও প্রায় অর্ধেক কন্যাশিশুর বিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই হয়ে যায়।

জন্ম নিবন্ধনের হার এখনও কম, মাত্র ৫৯ শতাংশ; যা শিশুদের মৌলিক অধিকার ও সেবায় প্রবেশাধিকার সীমিত করে।

মনোবিজ্ঞানী কাজী রুমানা হক বলেন, “এমন পরিবেশে বড় হওয়া শিশু ‘নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখাই বন্ধ করে দেয়।” দারিদ্র্য, অপবাদ ও সহায়তার অভাব তাদের অনেককে মাদক, শোষণ বা অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আবু আহমেদ ফাইজুল কবীর বলেন, “যদি আইনপ্রয়োগ, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী না করা হয়, তবে বাংলাদেশ একটি পুরো প্রজন্মকে শোষণের কাছে হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।”

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য

এমআইসিএস জরিপের তথ্য বলছে—অগ্রগতি ও পশ্চাদপসরণের এক জটিল মিশ্রণ এখন বাংলাদেশে দৃশ্যমান। শিশু অপুষ্টির ‘ওয়েস্টিং’ হার ২০১৯ সালের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে।

মায়েদের মধ্যে অ্যানিমিয়ার হার ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ।

কিশোরী মাতৃত্বের হার বেড়ে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৯২ জনে পৌঁছেছে। এসব কিশোরী মায়েদের নবজাতক জীবীতের হার প্রতি হাজোরে মাত্র ২২।

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রসবের মধ্যে এখন ৭৫ শতাংশের বেশি সি-সেকশন, যা চিকিৎসা-পরামর্শের অভাব ও অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

ফ্লাওয়ার্স জানান, জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ শতাংশ মেয়ে প্রথমবার মাসিক শুরু হওয়ার সময় বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানত না; এটি কিশোরীদের স্বাস্থ্য জ্ঞানে উদ্বেগজনক ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

স্যানিটেশন কাভারেজ ৭৩ শতাংশে উন্নীত হলেও নিরাপদভাবে ব্যবস্থাপিত পানির প্রাপ্যতা কমে ৩৯.৩% হয়েছে—ফলে ১০ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ দূষিত উৎসের ওপর নির্ভর করছে।

জরিপে দেখা গেছে—প্রায় অর্ধেক পানির উৎস ও ৮০ শতাংশের বেশি বাড়ির পানি নমুনায় ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

জলবায়ুজনিত দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা গতবছর ১০ শতাংশের বেশি পানিসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যা সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার প্রায় ৮০ শতাংশ হলেও মাধ্যমিকে তা দ্রুত কমে যায়।

শেখার ফলাফল এখনও দুর্বল—অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মৌলিক পড়া বা গণিত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।

ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে—শিশুশ্রম ও শেখার ঘাটতির মিলিত প্রভাব দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে “পারফেক্ট স্টর্ম” তৈরি করছে।

ঢাকার রাস্তায় সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা

জাতীয় তথ্যের বাইরেও ঢাকার বাস্তবতা আরও ভীতিকর।

সরেজমিনে এক রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে—ফ্লাইওভার, ফুটপাত, বাজারের পাশে, ব্যস্ত মোড়ে হাজারের বেশি বেশি শিশু ঘুমাতে দেখা গেছে।

ফার্মগেটের খামারবাড়ি মোড়ে রাত ৪টায় ৩০ জনের বেশি শিশু ও পরিবারকে ফুটপাত ঘুমাতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে তিন মাস বয়সী শিশুও দেখা গেছে।

তাদের মধ্যে অনেক শিশু স্পষ্টতই অপুষ্ট; অনেকে নিয়মিত নেশা করার কথাও স্বীকার করেছে।

পুলিশ জানায়—একই শিশুদের বারবার আটক করলেও তাদের জন্য কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।

এক পুলিশ সদস্য জানান—একজন আটক শিশুরা হেফাজতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল; পুলিশ জানত না তাকে কোথায় পাঠানো উচিত বা কীভাবে সহায়তা দিতে হবে।

সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বাজেট থাকা সত্ত্বেও ভয়াবহভাবে অব্যবহৃত। ৩৫ শিশু ধারণক্ষমতার কামরালপুর কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা গেছে—মাত্র সাতজন শিশু রয়েছে।

পরিচ্ছন্নতা, তদারকি ও মৌলিক সেবা—সবকিছুরই ঘাটতি দেখা গেছে সেখানে। সদরঘাট আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা গেছে—কোনও কর্মী ছাড়াই শিশুরা নদীতে গোসল করছে।

এনজিও বলছেন—রাষ্ট্রীয় সেবা মারাত্মকভাবে অপ্রতুল; হালনাগাদ তথ্য নেই, সমন্বয় নেই, শিশু-বান্ধব পরিবেশ নেই।

বেসরকারি সংস্থা লিডোর নির্বাহী পরিচালক বলেন, “এই শিশুরাই জাতির সম্পদ। রাষ্ট্র ও এনজিওদের শক্তিশালী সমন্বয় না হলে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।”

গবেষণা বলছে—বাংলাদেশে ৩৪ লাখ শিশু রাস্তা-ভিত্তিক পরিবেশে বড় হচ্ছে—হয়রানি, সহিংসতা, আবহাওয়ার ঝুঁকি ও শোষণের পুরোপুরি মুখোমুখি হয়ে।

বাংলাদেশের জন্য এক এমন সময়, যা এড়ানো যাবে না

সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—হটলাইন, আশ্রয়কেন্দ্র ও সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে; তবে দক্ষ জনবল ঘাটতি ও দুর্বল মনিটরিংয়ের বিষয়টিও স্বীকার করেছে তারা।

এদিকে এসডিসি, মার্কিন সরকার, ইউএনএইচসিআর, ইউএনএফপিএ ও আইইডিসিআরসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিকস তথ্য অনুযায়ী জরুরি নীতি পদক্ষেপে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইউনিসেফ সতর্ক করে বলছে—বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। শিশুশ্রম, সিসাদূষণ, অপুষ্টি ও নিরাপদ পানি সংকট ইতোমধ্যে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনছে।

এ প্রসঙ্গে ফ্লাওয়ার্স বলেন, “আমরা এখনও প্রতিটি শিশুর বাঁচা, বেড়ে ওঠা ও শেখার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না। বাংলাদেশকে এখনই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে; অন্যথায় লাখ লাখ শিশুকে পেছনে ফেলে উন্নত-আয়ের দেশের পথে এগোনো সম্ভব হবে না।”

সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন