ঢাকা ০৩:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
৩০ ফিলিস্তিনির মৃতদেহ ফেরত দিয়েছে ইসরায়েল, গাজায় ফের হামলা টেকনাফের মাহত আমিন র‍্যাবের জালে ১৫০০ রানার নিয়ে কক্সবাজার ম্যারাথন সম্পন্ন এক নামে ১০টির বেশি সিম থাকলে বন্ধ হবে শনিবার থেকে উখিয়া অনলাইন প্রেসক্লাবের কার্যকরী কমিটির শেষ সভা অনুষ্ঠিত; দায়িত্বে নির্বাচন কমিশন  হ্নীলার সড়ক দূর্ঘটনায় আরেকজনের মৃত্যু… টেকনাফে পুলিশের অভিযানে ৫৬ হাজার ইয়াবা উদ্ধার হ্নীলায় সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল চালকের ১৯ দিন ছিলেন চিকিৎসাধীন > চলে গেলেন মাইন বি’স্ফোর’ণে আহ’ত বিজিবি সদস্য প্রতিবাদের মুখে কবিতা চত্বরে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করলো পর্যটন কর্পোরেশন জাতিসংঘ সামাজিক সম্মেলনে যোগ দেবেন সিইএইচআরডিএফ প্রধান নির্বাহী মোঃ ইলিয়াছ মিয়া নাইক্ষ্যংছড়িতে ‘তারুণ্য উৎসব ২০২৫’ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বক্তা সাংবাদিক কন্যা নুরিয়ান হাসান ফাল্গুন’র মোড়ক উন্মোচন শনিবার টেকনাফে দেড় কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার করলো কোস্টগার্ড ৮ মাস পর খুললেও সেন্টমার্টিন যাবে না জাহাজ: পর্যটন ও পরিবেশ দু’টিই বাঁচানোর তাগিদ

ব্যাংক একত্রীকরণ : নাম বদল নাকি বাস্তব পরিবর্তন?

সকালে এক ব্যক্তি প্রতিদিনের মতো ব্যাংকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হাতে চেক বই আর জমার খাতা। কিন্তু ব্যাংকে পৌঁছে দেখলেন, তার পরিচিত সেই শাখার নামই বদলে গেছে! কেউ জানায়নি, কেউ ব্যাখ্যা দেয়নি, তার ব্যাংকটি এখন আর একক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, বরং পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের একটি নতুন নামের নিচে “একত্রীকৃত” হয়ে গেছে।

এই চিত্রটিই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান বাস্তবতা। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, পাঁচটি দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত বাণিজ্যিক ব্যাংককে একত্র করে একটি নতুন ব্যাংক গঠন করা হবে। অর্থাৎ “Consolidation” বা “একত্রীকরণ”। একত্রীকরণ মূলত দুর্বল ব্যাংক গুলোকে এক ছাতার নিচে এনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নতুন নাম দিয়ে পুনর্গঠন করার প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশে এর ইতিহাস এটি নতুন নয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর সরকার দেশের ১২টি বেসরকারি ব্যাংককে একত্র করে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, রাজনৈতিক নিয়োগ, অদক্ষতা ও ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি এই একত্রীকরণকে দুর্বল করে দেয়।

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে শুরু হয় বেসরকারিকরণ, কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অনাদায়ী ঋণের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি মেলেনি। আজও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১০ শতাংশ, কিছু ব্যাংকে তা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪)।

এই প্রেক্ষাপটে একত্রীকরণ বা consolidation নিয়ে আসা হয়েছে স্থিতিশীলতার আশায়। মূল উদ্দেশ্য, দুর্বল ব্যাংক গুলোকে একত্র করে একটি তুলনামূলক ভাবে শক্ত ভিত্তি তৈরি করা, খরচ কমানো এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, একত্রীকরণ সফল হতে হলে শুধু নাম বদল নয়, প্রয়োজন গভীর কাঠামোগত সংস্কার।

বিশ্বে এর সফলতা-ব্যর্থতা দুই-ই আছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে (merger) বাজার স্থিতিশীল রাখে, যেমন JP Morgan Chase অধিগ্রহণ করে Bear Stearns। এতে বাজারে আস্থা ফেরে এবং আমানতকারীরা সুরক্ষা পায় (সূত্র: U.S. Federal Reserve Report on Financial Stability, 2009).

২০১৯ সালে ভারত ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে একত্র করে ৪টি বড় ব্যাংকে রূপান্তর করে (consolidation)। এর আগে তারা খারাপ ঋণ ছেঁটে ফেলে, দক্ষ পরিচালনা বোর্ড নিয়োগ দেয় এবং রিজার্ভ ব্যাংক কঠোর তদারকি শুরু করে। ফলাফল, ব্যাংক খাত পুনরুজ্জীবিত হয়, কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় (সূত্র: Reserve Bank of India, Consolidation Report 2021).

কিন্তু সব দেশই সফল হয়নি। ইউরোপে Royal Bank of Scotland (RBS) একীভূতকরণের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে; ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকারকে ৪৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা দিতে হয়। পরে সরকার নিজেই ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের ও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে (সূত্র: Financial Conduct Authority, UK). ভারতের IDBI Bank ২০০৫ সালে একীভূত হওয়ার পরও বিপুল খারাপ ঋণে জর্জরিত। ২০১৯ সালে সরকারকে ৯,০০০ কোটি রুপি সহায়তা দিতে হয়, তবু ব্যাংকটি এখনো পূর্ণ পুনরুদ্ধার করতে পারেনি (সূত্র: The Times of India)।

ইতিহাস তাই বলছে, ব্যাংক একত্রীকরণ সফল হয় তখনই, যখন সেটির সঙ্গে প্রকৃত অর্থনৈতিক পুনঃমূল্যায়ন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিনির্ধারণ যুক্ত থাকে। অন্যথায় এটি শুধু “সমস্যার পুনঃপ্যাকেজিং” মাত্র।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই একত্রীকরণ কি সত্যিই আর্থিক সংস্কারের অংশ, নাকি কাগজে-কলমে একটি নাম পরিবর্তন? যদি এটি হয় দুর্বল ব্যাংক গুলোর দায় লুকানোর উপায়, তাহলে এতে আর্থিক খাতের আস্থা আরও কমে যাবে। কিন্তু যদি এটি হয় সুশাসন, পেশাদারিত্ব, এবং সম্পদের বাস্তব পুনর্মূল্যায়নের ভিত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপ, তাহলে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

ইতিহাস আমাদের সামনে দুই পথ দেখিয়ে রেখেছে, একদিকে আছে নাম বদলের ভেতর লুকানো সমস্যার পাহাড়, অন্যদিকে আছে সঠিক নীতি ও ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা। এখন নির্ভর করছে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব, নাকি ইতিহাসকে আবারও পুনরাবৃত্তি হতে দেব।

শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক, লেখক ও চিন্তক

ট্যাগ :

৩০ ফিলিস্তিনির মৃতদেহ ফেরত দিয়েছে ইসরায়েল, গাজায় ফের হামলা

This will close in 6 seconds

ব্যাংক একত্রীকরণ : নাম বদল নাকি বাস্তব পরিবর্তন?

আপডেট সময় : ০৯:৩২:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

সকালে এক ব্যক্তি প্রতিদিনের মতো ব্যাংকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হাতে চেক বই আর জমার খাতা। কিন্তু ব্যাংকে পৌঁছে দেখলেন, তার পরিচিত সেই শাখার নামই বদলে গেছে! কেউ জানায়নি, কেউ ব্যাখ্যা দেয়নি, তার ব্যাংকটি এখন আর একক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, বরং পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের একটি নতুন নামের নিচে “একত্রীকৃত” হয়ে গেছে।

এই চিত্রটিই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান বাস্তবতা। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, পাঁচটি দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত বাণিজ্যিক ব্যাংককে একত্র করে একটি নতুন ব্যাংক গঠন করা হবে। অর্থাৎ “Consolidation” বা “একত্রীকরণ”। একত্রীকরণ মূলত দুর্বল ব্যাংক গুলোকে এক ছাতার নিচে এনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নতুন নাম দিয়ে পুনর্গঠন করার প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশে এর ইতিহাস এটি নতুন নয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর সরকার দেশের ১২টি বেসরকারি ব্যাংককে একত্র করে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, রাজনৈতিক নিয়োগ, অদক্ষতা ও ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি এই একত্রীকরণকে দুর্বল করে দেয়।

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে শুরু হয় বেসরকারিকরণ, কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অনাদায়ী ঋণের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি মেলেনি। আজও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১০ শতাংশ, কিছু ব্যাংকে তা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪)।

এই প্রেক্ষাপটে একত্রীকরণ বা consolidation নিয়ে আসা হয়েছে স্থিতিশীলতার আশায়। মূল উদ্দেশ্য, দুর্বল ব্যাংক গুলোকে একত্র করে একটি তুলনামূলক ভাবে শক্ত ভিত্তি তৈরি করা, খরচ কমানো এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, একত্রীকরণ সফল হতে হলে শুধু নাম বদল নয়, প্রয়োজন গভীর কাঠামোগত সংস্কার।

বিশ্বে এর সফলতা-ব্যর্থতা দুই-ই আছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে (merger) বাজার স্থিতিশীল রাখে, যেমন JP Morgan Chase অধিগ্রহণ করে Bear Stearns। এতে বাজারে আস্থা ফেরে এবং আমানতকারীরা সুরক্ষা পায় (সূত্র: U.S. Federal Reserve Report on Financial Stability, 2009).

২০১৯ সালে ভারত ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে একত্র করে ৪টি বড় ব্যাংকে রূপান্তর করে (consolidation)। এর আগে তারা খারাপ ঋণ ছেঁটে ফেলে, দক্ষ পরিচালনা বোর্ড নিয়োগ দেয় এবং রিজার্ভ ব্যাংক কঠোর তদারকি শুরু করে। ফলাফল, ব্যাংক খাত পুনরুজ্জীবিত হয়, কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় (সূত্র: Reserve Bank of India, Consolidation Report 2021).

কিন্তু সব দেশই সফল হয়নি। ইউরোপে Royal Bank of Scotland (RBS) একীভূতকরণের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে; ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকারকে ৪৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা দিতে হয়। পরে সরকার নিজেই ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের ও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে (সূত্র: Financial Conduct Authority, UK). ভারতের IDBI Bank ২০০৫ সালে একীভূত হওয়ার পরও বিপুল খারাপ ঋণে জর্জরিত। ২০১৯ সালে সরকারকে ৯,০০০ কোটি রুপি সহায়তা দিতে হয়, তবু ব্যাংকটি এখনো পূর্ণ পুনরুদ্ধার করতে পারেনি (সূত্র: The Times of India)।

ইতিহাস তাই বলছে, ব্যাংক একত্রীকরণ সফল হয় তখনই, যখন সেটির সঙ্গে প্রকৃত অর্থনৈতিক পুনঃমূল্যায়ন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিনির্ধারণ যুক্ত থাকে। অন্যথায় এটি শুধু “সমস্যার পুনঃপ্যাকেজিং” মাত্র।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই একত্রীকরণ কি সত্যিই আর্থিক সংস্কারের অংশ, নাকি কাগজে-কলমে একটি নাম পরিবর্তন? যদি এটি হয় দুর্বল ব্যাংক গুলোর দায় লুকানোর উপায়, তাহলে এতে আর্থিক খাতের আস্থা আরও কমে যাবে। কিন্তু যদি এটি হয় সুশাসন, পেশাদারিত্ব, এবং সম্পদের বাস্তব পুনর্মূল্যায়নের ভিত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপ, তাহলে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

ইতিহাস আমাদের সামনে দুই পথ দেখিয়ে রেখেছে, একদিকে আছে নাম বদলের ভেতর লুকানো সমস্যার পাহাড়, অন্যদিকে আছে সঠিক নীতি ও ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা। এখন নির্ভর করছে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব, নাকি ইতিহাসকে আবারও পুনরাবৃত্তি হতে দেব।

শেখ জাহাঙ্গীর হাছান মানিক, লেখক ও চিন্তক