ঢাকা ০৯:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পেকুয়ায় আগুনে পুড়লো ছয় বসতবাড়ি সিএনজির চাকায় পি’ষ্ট হয়ে মা’রা গেলো ১২ বছরের মোহাম্মদ সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত বৈঠক রামু সেনানিবাসে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হলো সশস্ত্র বাহিনী দিবস ঢাকায় বর্ষসেরা সাংবাদিকের সম্মাননা পেলেন কক্সবাজারের ইরফান বিজিবির ডগ “রকি” উদ্ধার করলো ৬০ হাজার ইয়াবা, যুবক আটক বাংলাদেশী ২৮ মাঝিমাল্লাসহ ফিশিং ট্রলার ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় কোস্টগার্ড ইট আর মাটিতে চাপা পড়ে নিভল ৬ প্রাণ, আহত শতাধিক ভূমিকম্পের পর প্রধান উপদেষ্টার বার্তা সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা ভূমিকম্পে যে ঝাঁকুনি হলো, তা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ: ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার ৫.৭ মাত্রার এমন ভূমিকম্প ‘আগে কখনো দেখেনি’ ঢাকা ভূমিকম্পে পুরান ঢাকায় নিহত ৩ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ব্যবসায়ীকে অ’পহ’রন: রোহিঙ্গা স’ন্ত্রা’সীদের সাথে এপিবিএনের ৬১ রাউন্ড গো’লাগু’লি যে ৪ বিষয়ে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে দোয়া করেছেন মহানবী (সা.)

পুলিশকে সরাসরি গুলির নির্দেশে মানবাধিকারকর্মীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া

গত সপ্তাহে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। ওয়্যারলেসে এক বার্তায় সিএমপি পুলিশ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন তিনি। একই কায়দায় রবিবার (১৬ নভেম্বর) ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। পুলিশ সদস্যদের এমন নির্দেশ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, এটি অপরাধ উসকে দেওয়ার মতো বার্তা।

গত মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ওয়্যারলেস সেটে টহল ও থানা পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘দেখামাত্র ব্রাশফায়ার নিরস্ত্র জনসাধারণের জন্য নয়। যার হাতে অস্ত্র নেই, তার ওপর তো আর এসএমজি ইউজ করবো না। সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী যারা তাদের জন্য এই নির্দেশনা। আমার এলাকায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা খুন করে গেলো (বায়েজিদের চালিতাতলী)। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে তারা যেন আর সাহস না পায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চট্টগ্রাম নগরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা যেন স্বপ্নেও এটি কল্পনা করতে না পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।’

একইভাবে রবিবার (১৬ নভেম্বর) বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ওয়্যারলেস বার্তায় ডিএমপির মাঠপর্যায়ে নিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার কথা বলেছি। যারা মানুষ বা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন—আইনসম্মতভাবেই তাদের ওপর গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

পুলিশকে এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে দেশে যে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার ঘটনা ঘটছে, তা নিশ্চয়ই গভীরভাবে উদ্বেগজনক। কিন্তু এর মধ্যেই আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নির্দেশনা। এ ধরনের নির্দেশ কেবল দায়িত্বহীনই নয়, এটি সরাসরি দেশের সংবিধান, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থি।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে গুলি করার নির্দেশ এই অধিকারগুলোকে নিশ্চিতভাবেই ক্ষুণ্ন করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইন, দণ্ডবিধি কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির কোনও ধারাই ‘দেখামাত্র গুলি’ করার অনুমতি দেয় না। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পেশাদারত্বের মূলনীতি হলো অভিযুক্ত অপরাধী হলেও তাকে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা।

মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য মানবাধিকারবিরোধী। যে হামলা করবে বা বোমা মারবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার কয়েকটা মৌলিক নীতিমালা আছে, কোন জায়গায় কী পরিমাণ প্রয়োজন, কোন জায়গায় সমানুপাতিকভাবে গুলি করা যাবে–সেটার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার কথা। সেই নীতিমালা পালন না করে, ওয়্যারলেসে সিএমপি কমিশনার বলেছেন ব্রাশফায়ার করার কথা। আর এখন ডিএমপি কমিশনার বললেন গুলি চালাতে। এটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন তারা। এই মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা নতুন বাংলাদেশে বা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন এই ধরনের অপরাধমূলক আকাঙ্ক্ষা করতে পারেন না। এটি অপরাধ এবং মানবাধিকার হরণের রাজনীতিকে উসকে দেয়। এটি তারা করতে পারেন না।’

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত তাদের মাথায় রাখতে হবে যে এই ধরনের ঘোষণা যখন দেন, তখন বাংলাদেশে ইতোমধ্যে চার হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বিগত ১৭ বছর। এর আগেও যদি হিসাব করা হয় তাহলে পাঁচ হাজারের ওপরে হবে। বাংলাদেশের সীমান্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, সীমান্তে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশনা ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া আছে। এরকম একটা বাস্তবতায়, যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের হাতছানির মধ্যে আছে এবং আজও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাস্তির আদেশ হয়েছে, সেই মুহূর্তে আরেকটি মানবাধিকার হরণের রাজনীতির কথা বলা এবং আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা নিঃসন্দেহে প্রবঞ্চনামূলক, মানবাধিকার হরণের সুযোগ প্রসারিত করবে এবং একইসঙ্গে আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে যাবে।’

মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘জননিরাপত্তার নামে বিচারবহির্ভূত বলপ্রয়োগের বৈধতা কখনোই গৃহীত হয় না। এমন নির্দেশ কেবল সহিংসতাকে উসকে দেয়, জবাবদিহির জায়গাটিকে এড়িয়ে যায় এবং নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা বাড়ায়।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি নিজেই আইনের বাইরে গিয়ে আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোন ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যেকোনও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ। নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, তবে সেটা হতে হবে প্রমাণ, তদন্ত ও আদালতের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, আতঙ্কিত করা নয়। মানবাধিকার ও সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোই আমাদের নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করবে, নিশ্চিতভাবেই অন্য কোনও পথে নয়।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাদের এমন সিদ্ধান্ত অন্যায়মূলক এবং সংবিধান বহির্ভূত। তারা এটা বলে প্রমাণ করলো যে, তাদের আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। এটা স্বৈরসাশকের আমলেও দেখেছি। একটি মামলার রায়ে সুপেরিয়র রেসপানসিবিলিটির কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা সরাসরি গুলি না করেও সাজা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে যেখানে বিচার করার মাধ্যমে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে পুলিশ তাদের নিজেদের আইন বা সংবিধান লঙ্ঘণ করে দেশের সকল আইনকে ভঙ্গ করেছে। এটি বাংলাদেশকে মানায়না।’

গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সিএমপি কমিশনার ব্রাশফায়ারের নির্দেশ দেওয়ার পর আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলে, এই ধরনের নির্দেশ সরাসরি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করার শামিল, যা সংবিধান, আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং আইনের আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন অপরাধীকেও আইনি প্রক্রিয়া ব্যতীত হত্যা বা গুলি চালানোর নির্দেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জোর দিয়ে বলছে, এই ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সদস্যদের মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালন সম্পর্কে যথাযথ বার্তা দিতে হবে। সরকারকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুলি চালানোর নির্দেশ রাষ্ট্রের নীতি ও আইনি কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা। চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্য দায়িত্বশীল প্রশাসনিক আচরণের পরিপন্থি এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। আসক মনে করে, এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে, অন্যথায় এমন নির্দেশ বা মনোভাব ভবিষ্যতে প্রাণহানি ও বিচারবহির্ভূত ঘটনার আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের জন্য অপ্রত্যাশিত।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

This will close in 6 seconds

পুলিশকে সরাসরি গুলির নির্দেশে মানবাধিকারকর্মীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া

আপডেট সময় : ০২:৪৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

গত সপ্তাহে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। ওয়্যারলেসে এক বার্তায় সিএমপি পুলিশ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন তিনি। একই কায়দায় রবিবার (১৬ নভেম্বর) ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। পুলিশ সদস্যদের এমন নির্দেশ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, এটি অপরাধ উসকে দেওয়ার মতো বার্তা।

গত মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ওয়্যারলেস সেটে টহল ও থানা পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘দেখামাত্র ব্রাশফায়ার নিরস্ত্র জনসাধারণের জন্য নয়। যার হাতে অস্ত্র নেই, তার ওপর তো আর এসএমজি ইউজ করবো না। সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী যারা তাদের জন্য এই নির্দেশনা। আমার এলাকায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা খুন করে গেলো (বায়েজিদের চালিতাতলী)। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে তারা যেন আর সাহস না পায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চট্টগ্রাম নগরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা যেন স্বপ্নেও এটি কল্পনা করতে না পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।’

একইভাবে রবিবার (১৬ নভেম্বর) বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ওয়্যারলেস বার্তায় ডিএমপির মাঠপর্যায়ে নিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার কথা বলেছি। যারা মানুষ বা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন—আইনসম্মতভাবেই তাদের ওপর গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

পুলিশকে এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে দেশে যে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার ঘটনা ঘটছে, তা নিশ্চয়ই গভীরভাবে উদ্বেগজনক। কিন্তু এর মধ্যেই আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নির্দেশনা। এ ধরনের নির্দেশ কেবল দায়িত্বহীনই নয়, এটি সরাসরি দেশের সংবিধান, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থি।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে গুলি করার নির্দেশ এই অধিকারগুলোকে নিশ্চিতভাবেই ক্ষুণ্ন করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইন, দণ্ডবিধি কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির কোনও ধারাই ‘দেখামাত্র গুলি’ করার অনুমতি দেয় না। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পেশাদারত্বের মূলনীতি হলো অভিযুক্ত অপরাধী হলেও তাকে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা।

মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য মানবাধিকারবিরোধী। যে হামলা করবে বা বোমা মারবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার কয়েকটা মৌলিক নীতিমালা আছে, কোন জায়গায় কী পরিমাণ প্রয়োজন, কোন জায়গায় সমানুপাতিকভাবে গুলি করা যাবে–সেটার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার কথা। সেই নীতিমালা পালন না করে, ওয়্যারলেসে সিএমপি কমিশনার বলেছেন ব্রাশফায়ার করার কথা। আর এখন ডিএমপি কমিশনার বললেন গুলি চালাতে। এটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন তারা। এই মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা নতুন বাংলাদেশে বা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন এই ধরনের অপরাধমূলক আকাঙ্ক্ষা করতে পারেন না। এটি অপরাধ এবং মানবাধিকার হরণের রাজনীতিকে উসকে দেয়। এটি তারা করতে পারেন না।’

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত তাদের মাথায় রাখতে হবে যে এই ধরনের ঘোষণা যখন দেন, তখন বাংলাদেশে ইতোমধ্যে চার হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বিগত ১৭ বছর। এর আগেও যদি হিসাব করা হয় তাহলে পাঁচ হাজারের ওপরে হবে। বাংলাদেশের সীমান্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, সীমান্তে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশনা ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া আছে। এরকম একটা বাস্তবতায়, যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের হাতছানির মধ্যে আছে এবং আজও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাস্তির আদেশ হয়েছে, সেই মুহূর্তে আরেকটি মানবাধিকার হরণের রাজনীতির কথা বলা এবং আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা নিঃসন্দেহে প্রবঞ্চনামূলক, মানবাধিকার হরণের সুযোগ প্রসারিত করবে এবং একইসঙ্গে আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে যাবে।’

মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘জননিরাপত্তার নামে বিচারবহির্ভূত বলপ্রয়োগের বৈধতা কখনোই গৃহীত হয় না। এমন নির্দেশ কেবল সহিংসতাকে উসকে দেয়, জবাবদিহির জায়গাটিকে এড়িয়ে যায় এবং নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা বাড়ায়।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি নিজেই আইনের বাইরে গিয়ে আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোন ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যেকোনও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ। নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, তবে সেটা হতে হবে প্রমাণ, তদন্ত ও আদালতের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, আতঙ্কিত করা নয়। মানবাধিকার ও সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোই আমাদের নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করবে, নিশ্চিতভাবেই অন্য কোনও পথে নয়।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাদের এমন সিদ্ধান্ত অন্যায়মূলক এবং সংবিধান বহির্ভূত। তারা এটা বলে প্রমাণ করলো যে, তাদের আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। এটা স্বৈরসাশকের আমলেও দেখেছি। একটি মামলার রায়ে সুপেরিয়র রেসপানসিবিলিটির কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা সরাসরি গুলি না করেও সাজা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে যেখানে বিচার করার মাধ্যমে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে পুলিশ তাদের নিজেদের আইন বা সংবিধান লঙ্ঘণ করে দেশের সকল আইনকে ভঙ্গ করেছে। এটি বাংলাদেশকে মানায়না।’

গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সিএমপি কমিশনার ব্রাশফায়ারের নির্দেশ দেওয়ার পর আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলে, এই ধরনের নির্দেশ সরাসরি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করার শামিল, যা সংবিধান, আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং আইনের আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন অপরাধীকেও আইনি প্রক্রিয়া ব্যতীত হত্যা বা গুলি চালানোর নির্দেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জোর দিয়ে বলছে, এই ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সদস্যদের মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালন সম্পর্কে যথাযথ বার্তা দিতে হবে। সরকারকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুলি চালানোর নির্দেশ রাষ্ট্রের নীতি ও আইনি কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা। চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্য দায়িত্বশীল প্রশাসনিক আচরণের পরিপন্থি এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। আসক মনে করে, এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে, অন্যথায় এমন নির্দেশ বা মনোভাব ভবিষ্যতে প্রাণহানি ও বিচারবহির্ভূত ঘটনার আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের জন্য অপ্রত্যাশিত।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন