স্কুলজীবনের সেই চেনা দৃশ্য—ক্লাস সিক্স বা নাইনে হঠাৎ নতুন একদল ছাত্রছাত্রী। প্রথম কয়েকদিন চুপচাপ, কারও সাথে তেমন মেশে না, চোখে পড়ে না। কিন্তু সময় গড়াতেই বোঝা যায়, এই ‘নিউ কিড’ আসলে আলাদা ধাতের। পরীক্ষার রেজাল্টে টপ, স্পোর্টস ডে থেকে সায়েন্স ফেস্ট—সবখানেই দাপট। পুরোনোরা তখন মনে মনে প্রশ্ন করে, “এই হালায় কেডা রে?”
এবারের বিপিএলে নোয়াখালী এক্সপ্রেসকে দেখলে ঠিক সেই রকমই এক অনুভূতি আসে। আলোচনার কেন্দ্রে না থেকেও, নিঃশব্দে এমন এক স্কোয়াড দাঁড় করিয়েছে দলটি—যেটা হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্নটা তাই একটাই—নোয়াখালী কি এবারের বিপিএলের সেই ‘ক্লাসে নতুন আসা ছেলেটা’, যে শেষ পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে দেবে?
নোয়াখালীবাসীদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা—নোয়াখালী বিভাগ আর বিপিএলে নোয়াখালী দল। প্রথমটা এখনও অধরা, তবে দ্বিতীয় স্বপ্নটা এবছর বাস্তব হয়েছে দেশ ট্রাভেলসের মালিকানায় নোয়াখালী এক্সপ্রেস মাঠে নামার মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই এতে নোয়াখালী অঞ্চলে তৈরি হয়েছে তুমুল উত্তেজনা। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে বিপিএলের আলোচনায় নোয়াখালী বরাবরই ছিল আড়ালে। চট্টগ্রামের দল গঠন নিয়ে বিতর্ক, রংপুর-সিলেটের বড় সাইনিং, রাজশাহীর পেশাদারিত্ব কিংবা শাকিব খানের ঢাকা—এই সব হাইপের ভিড়ে নোয়াখালীর নাম খুব একটা শোনা যায়নি।
বরং আলোচনায় এসেছে দু’টি পার্শ্বঘটনায়—ব্যাচেলর পয়েন্টখ্যাত পলাশকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা এবং দলের মালিকের ‘জাকের আলীকে অধিনায়ক হিসেবে পছন্দ না’ মন্তব্য। এই দুটো ইস্যুই মূলত নোয়াখালী এক্সপ্রেসকে আলোচনায় এনেছে। অথচ মাঠের ক্রিকেটের প্রস্তুতিটা হয়েছে বেশ পরিমিত, হিসেবি ও বাস্তবধর্মী।
ব্যাটিং বিভাগে নোয়াখালীর শক্তি চোখে পড়ার মতো। কুশল মেন্ডিস, জনসন চার্লস, হায়দার আলীর মতো আন্তর্জাতিক টি২০ অভিজ্ঞরা তো আছেনই। পরে যুক্ত হয়েছে মাজ সাদাকাত, মোহাম্মদ নবী—যারা ব্যাটে-বলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। দেশি ক্রিকেটারদের তালিকাও ভারসাম্যপূর্ণ—হাবিবুর রহমান সোহান, সৌম্য সরকার, জাকের আলী, মাহিদুল, সৈকত আলী, সাব্বির হোসেন—কেউই হয়তো একা ‘মেগাস্টার’ নন, কিন্তু সবাই মিলেই তৈরি করতে পারেন কার্যকর টি২০ ইউনিট।
সম্ভাব্য কম্বিনেশনটা কাগজে-কলমেই ভয় ধরানোর মতো। হাবিবুর রহমান সোহানের সঙ্গে মাজ সাদাকাত ওপেনিংয়ে—রাইজিং স্টার এশিয়া কাপের দুই আলোচিত নাম। এরপর ওয়ান ডাউনে সৌম্য সরকার বা কুশল মেন্ডিস, চার নম্বরে জনসন চার্লস। মিডল অর্ডারে মাহিদুল, সৈকত, সাব্বির—যারা পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে জানে। লেট অর্ডারে মোহাম্মদ নবী, হায়দার আলী, জাকের আলীর মতো পাওয়ার হিটাররা থাকলে যে কোনো বোলিং আক্রমণই চাপের মুখে পড়বে।
পেস বিভাগে নোয়াখালী আরও ভয়ংকর। হাসান মাহমুদ, রেজাউর রহমান রাজা, মুশফিক হাসানদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিলাল সামি, ইহসানুল্লাহ ও ইবরার আহমেদ। নতুন বলে আগ্রাসন, মিডল ওভারে পেসের ভ্যারিয়েশন, ডেথে গতি—সব উপাদানই আছে। বিশেষ করে ইবরার আহমেদের মতো ইউএইর তরুণ প্রতিভাকে স্কাউট করা নোয়াখালীর ক্রিকেট বুদ্ধির পরিচয় দেয়।
স্পিন বিভাগে অবশ্য কিছুটা ঘাটতি আছে। দলে নেই কোনো খাঁটি অ্যাটাকিং লেগস্পিনার। মোহাম্মদ নবী ও নাজমুল অপু মূলত সাপোর্ট স্পিনার। তবে এখানেই ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ হতে পারেন ঠাকুরগাঁওয়ের বাঁহাতি স্পিনার আবু হাশিম। রবীন্দ্র জাদেজার অ্যাকশন নকল করে বোলিং করা এই তরুণ গত এক-দেড় বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে নজর কেড়েছেন। সঠিক ব্যবহার পেলে তিনি পুরো টুর্নামেন্টেরই ব্রেকআউট স্টার হয়ে উঠতে পারেন।
শীতকালীন বিপিএলে ময়েশ্চারযুক্ত ঘাসের পিচে ব্যাটিং ডেপথ ও শক্ত পেস আক্রমণ—এই দুটোই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সেই দিক থেকে নোয়াখালী এক্সপ্রেস বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুত। ২০২২ সালে গুজরাট টাইটান্স যেমন নিজেদের ডেব্যু মৌসুমেই আইপিএল জিতে সবাইকে অবাক করেছিল, বিপিএলেও কি তেমন এক চমক অপেক্ষা করছে?
সব আলোচনার বাইরে থেকে নিঃশব্দে শক্ত ভিত গড়ে তোলা নোয়াখালী এক্সপ্রেস তাই বিপিএলের বাকি দলগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে এক ‘অস্বস্তিকর’ প্রতিপক্ষ। উড়ে এসে জুড়ে বসা এই ‘নিউ কিড ইন স্কুল’-কে অবহেলা করলে, তার খেসারত যে বড় হতে পারে—সেটা বুঝে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সায়ন্তন ভট্টাচার্য 























