ঢাকা ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
সীমান্তে ফের মাইন বিস্ফোরণ, মিয়ানমার নাগরিক নিহত- বাংলাদেশি আহত চকরিয়া হারবাং ইউনিয়ন ছাত্রদলের আংশিক কমিটি গঠিত তারুণ্যের উৎসব উপলক্ষে সাঁতার প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন ৬ বছরে ২৫ হত্যাকান্ড: বদরখালীতে পুলিশ ফাঁড়ি পুনঃস্থাপনের দাবিতে এলাকাবাসীর মানববন্ধন উখিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে অস্ত্র ও মাদক কারবারি এনায়েত উল্লাহ আটক চার পিস ইয়াবা ধরতে উখিয়ার ওসির ‘আলোচিত অভিযান’ দোকান মালিক সমিতি ফেডারেশনের আজীবন সদস্য পদ থেকে মাহাবুবুর রহমান চৌধুরীর পদত্যাগ টিটিএন পরিবারের শোক: সাংবাদিক আনসার হোসেনের সহধর্মিণী আর নেই একনজরে চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন দোকান মালিক সমিতির সদস্য জিল্লু ও জাহেদের পদ বাতিল ঈদগাঁওতে দেশীয় অস্ত্রসহ সিএনজি চালককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ অনলাইনে জামিননামা গ্রহণ শুরু হচ্ছে কাল, এক ক্লিকে পৌঁছে যাবে জেলখানায়: আইন উপদেষ্টা মেক্সিকোয় ভারি বৃষ্টি, বন্যায় ৬৪ মৃত্যু; নিখোঁজ ৬৫ হঠাৎ মার্কিন দূতাবাসে নিরাপত্তা জোরদার ঈদগাঁওয়ের ইউএনও বিমল চাকমার বিরুদ্ধে মামলা, ২ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগ

‘সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার বেঁচে থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়’

‘উনিশ শ বিরানব্বই সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই আমার ইংরেজিতে অনার্স পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। কক্সবাজারের মত প্রান্তিক শহরে বড় হলেও ইংরেজি সাহিত্যের তৎকালীন খ্যাতিমান শিক্ষকদের অন্তত কয়েকজনের সম্পর্কে জানতাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ স্যারদের নাম তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইংরেজি বিতর্ক অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করতেন। মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে তাঁর চমৎকার ইংরেজি ও যুক্তিবাদী চিন্তার পরিচয় পেতাম। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরিতে ইংরেজি বিভাগের সেই সব গুণী শিক্ষকের বইপত্র পাওয়া যেত। স্কুলের বই বাদ দিয়ে আমার আগ্রহ ছিল তাঁদের লেখা পড়ার প্রতি। বলা বাহুল্য, অনেক কিছুই আমি বুঝতাম না, তবুও পড়তাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ‘অভিব্যক্তিবাদী নাটক’ নামের একটি বইয়ে তাঁর গুলশানের ‘ঝরোকা’ বাড়ির ঠিকানায় স্যারকে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলাম। জানিয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য পড়ার আগ্রহের কথা। কীভাবে ভালো ইংরেজি শেখা যায়, স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রকে তিনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চিঠির জবাব দিতে বিলম্ব করেননি। ইংরেজি বিভাগের কোন শিক্ষকের সাথে এটাই আমার প্রথম বোঝাপড়া।

ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। লিখতে বসেছি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার সম্পর্কে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পূর্বেই তিনি দেদীপ্যমান ও সুপরিচিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি, এই আফসোস নিয়েই পড়াশোনা এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি এফ. আর. হলে থাকি। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পর শুনলাম, ভাইভাতে এক্সটার্নাল হিসেবে আসছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। পরীক্ষা কমিটিতে আরও ছিলেন অধ্যাপক আবদুল ওয়াসীহ স্যার ও অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার স্যার। ‘মুখোমুখি বসিবার’ এই সুযোগ আমাকে আপ্লুত করার কথা ছিল, কিন্তু ফল হলো উল্টো। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। খুবই আতঙ্কিত বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার পড়াশোনা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারটা এবার ধরা পড়ে যাবে। মালির ঘাড়ে পড়া বলতে যা বোঝায়, আমার অবস্থা তখন ঠিক তা-ই। কোথাও পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। ওই পাহাড়ি ক্যাম্পাসে খুব অসহায় লাগছিল। কোথায় যাব, কী করব—এই ভাবতে ভাবতেই আমার ডাক পড়ল।

মোহাম্মদ আলী স্যারের কক্ষে ভাইভা চলছিল।
শুরু হলো কথোপকথন, ইংরেজিতে প্রশ্নবাণ। সিলেবাসে রিচার্ড শেরিডানের ‘দ্য রাইভালস’ নামে একটি কমেডি ছিল। নাটকের বিষয় হলো সামাজিক ভণ্ডামি ও প্রেমের ভুল-বোঝাবুঝি। সেখানে স্যার লুসিয়াস ও’ট্রিগার নামে একটি চরিত্র ছিল। চরিত্রটি নাটকের অন্যতম হাস্যকর ও স্মরণীয় অংশ, যা দর্শকদের হাসানোর পাশাপাশি সমাজের ভণ্ড প্রেমিকদের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও কাজ করে। মনজুর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “ট্রিগার মানে কী?” আমি বন্দুকের ট্রিগার চোখে দেখতে পেলেও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। চুপ করে রইলাম। স্যার আঙুল দিয়ে গুলি ছোড়ার মতো করে ট্রিগার টেনে দেখালেন। আমি তবুও চুপ। অবস্থা বেগতিক দেখে সরওয়ার স্যার এবং ওয়াসীহ স্যার আরও কয়েকটি সহজ প্রশ্ন করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। সে যাত্রায় ভাইভাতে টেনেটুনে পাস জুটেছিল।

এই ঘটনার প্রায় সাত-আট বছর পর আমি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। আমি একটি এনজিওতে ছিলাম। বলতে গেলে, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক মোহীত-উল-আলম স্যার আমাকে সাদাত জামান খানের মাধ্যমে একরকম পাকড়াও করেছিলেন। স্যারের দেওয়া সেই সম্মান আমি কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি, জানি না। স্যারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তখন শিক্ষকসংখ্যা ছিল অল্প, ছোট পরিসরে কাজ চলছিল। অধ্যাপক কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ স্যার তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মোহীত স্যার ঢাকা থেকে মনজুর স্যার এবং আরও কিছুদিন পর অধ্যাপক ফখরুল আলম ও অধ্যাপক কায়সার হক স্যারকে বিভাগে আনার চেষ্টা করছিলেন। এঁরা সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের, যাকে বলে তারকা শিক্ষক। তাঁরা প্রিমিয়ারে আসবেন, এটা আমি প্রায় অকল্পনীয়ই ভেবেছিলাম। দেখলাম, মনজুর স্যার সাড়া দিলেন। পরে বাকি দুজনও যুক্ত হলেন। মোহীত স্যার সাহিত্য সেমিনারের আয়োজন শুরু করলেন। প্রথম দিকে স্যাররা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন, মোহীত স্যার সভাপতিত্ব করতেন এবং অন্যরা আলোচক থাকতেন। আমরা শ্রোতা। ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর আমার জন্য আরেক আতঙ্ক শুরু হলো। মনজুর স্যার, বিল্লাহ স্যার ও মোহীত স্যার আমাদের প্রবন্ধ উপস্থাপনে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন, যেন আমরা শ্রোতা থেকে লেখক ও বক্তা হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এরই মধ্যে পেয়ে গেছি। বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে সেমিনার বলতে তেমন কিছু দেখিনি। প্রিমিয়ারে এটাকে অনেকটা রুটিন কাজে পরিণত করা হচ্ছিল। মোহীত স্যার যখন প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন, তখন আমাদের আলোচনা ও সভাপতিত্ব করতে বলতেন। কত অবলীলায় যে স্যার এই আদেশ দিতেন, তা ভেবে অবাক হতাম। সেবার মোহীত স্যার প্রবন্ধ দিলেন, আলোচক ছিলেন বিল্লাহ স্যার, মনজুর স্যার ও (সম্ভবত) সাদাত জামান খান। আমাকে বললেন সভাপতিত্ব করতে। মনজুর স্যারের সামনে সেদিন কেমন বলেছিলাম, তা আজ মনে নেই। কিন্তু বিল্লাহ স্যার পরদিন আমাকে বলেছিলেন, “জসীম, গতকাল তুমি খুব ভালো বলেছ।” যাঁরা বিল্লাহ স্যারকে চেনেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন, এটা একটা বিরাট প্রশংসা। আমার মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব চলে এল।

মনজুর স্যার এক দিনের জন্য আসতেন। অনেক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাজ থাকত। সকালে ক্লাস নিয়ে বিকেলে সেমিনারে অংশগ্রহণ করে সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে যেতেন। আমি অনেকটা তাঁর প্রটোকল অফিসারের মতো কাজগুলো দেখতাম। মোহীত স্যার তাঁর আসা-যাওয়া, সেমিস্টার, ক্লাসের বিষয় নির্বাচন, রুটিন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগের কাজটি আমাকে দিয়ে করাতেন। বিনিময়ে তাঁকে আমরা যে পারিশ্রমিক দিয়েছি, সত্যি বলতে কী, অনেক সময় আমি নিজেই লজ্জিত বোধ করেছি। বাংলাদেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কোর্স ও ক্লাস দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিকে সময় দেওয়াকে তিনি ‘ওয়ার্ক ফর লাভ’ বলতেন। কেবল মোহীত স্যার, বিল্লাহ স্যার ও সরওয়ার স্যারের টানেই তিনি এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ক্লাস ও সেমিনার ছাড়াও ইংরেজি বিভাগের প্রায় সব নিয়োগ, পদোন্নতি ও সিলেবাস প্রণয়নের কাজে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকতেন।

মনজুর স্যার খুব সহজেই জুনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এটি তাঁর একটি অসাধারণ গুণ ছিল। নাম ধরে ডাকতেন। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যুক্ত করতেন। ছোটকেও তিনি বড় করে দেখতেন বলেই আমার মতো মুখচোরা ছাত্রও স্যারের সঙ্গে সহজ হতে পেরেছিল। এমনকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তিনি অনেক সময় বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। তাঁর মধ্যে কৌতুকবোধ ছিল। খুব নিচু স্বরে কথা বলতেন। কাজের ফাঁকে নানা রকম মন্তব্য করতেন। খাবারের টেবিলে হালকা চালে অনেক কথা বলতেন। খুব পরিমিত খাবার খেতেন। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, বলতে গেলে তিনি কিছুই খেতেন না। সে কারণেই সম্ভবত খুব ছিমছাম ছিলেন। তাঁর সমবয়সীদের তুলনায় তিনি শারীরিকভাবে অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিলেন। ভুঁড়ি খুব অপছন্দ করতেন। কারও ভুঁড়ি থাকা মানে, তিনি বলতেন, লোকটির আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। কৌতুক করে ‘মধ্যপ্রদেশ’ সম্পর্কে সচেতন হতে বলতেন।

যা বলছিলাম, মোহীত স্যারকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি তাঁকে মোহীত স্যারের সমবয়সী ভাবতাম। পরে জানলাম, তিনি আমাদের বিল্লাহ স্যারের ব্যাচমেট এবং মোহীত স্যারের বছর দুয়েকের সিনিয়র। প্রিমিয়ারে এসে দেখলাম, তিনি মোহীত স্যারকে খুব স্নেহ করেন, অনেকটা বড় ভাইয়ের মতো। একবার কী একটা বিষয়ে বললেন, ‘মোহীত খুব কাজের ছেলে, ও পারবে।’ লেখক, কবি ও অধ্যাপক মোহীত-উল-আলমকে কেউ ‘ছেলে’ বলতে আমি সেদিনই প্রথম শুনলাম। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটি বিষয় নিয়ে মনজুর স্যারকে খুব রেগে যেতে দেখলাম। আমাকে বললেন, “তুমি তাদের বলে দিয়ো, মোহীত না থাকলে আমরা এখানে আসব না।” শুনতে আবেগি মন্তব্য মনে হলেও স্যার খুব চিন্তাভাবনা করেই কথাটা বলেছিলেন।

শিক্ষক, লেখক, সমালোচক, চিন্তক—যেভাবেই দেখি না কেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার ছিলেন ভালোর মধ্যে আরও ভালো। ভালো ছাত্র ভালো শিক্ষক হবেই, এমন কোনো কথা নেই। তিনি যত ভালো ছাত্র ছিলেন, তার চেয়ে ভালো শিক্ষক ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে অনেকেই ভালো পড়াতে পারেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। নিজ বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ইংরেজি পড়িয়েছেন, লিখেছেন, কিন্তু বাংলায় ছিলেন আরও ভালো। সাহিত্য সমালোচনা ছিল তাঁর পছন্দের জায়গা। দুর্বোধ্য বিষয়টি অনায়াসে আয়ত্ত করেছিলেন বলে শ্রেণিকক্ষে তা আরও সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। চিত্র সমালোচক হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মিডিয়ায় তিনি সেলিব্রিটি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন অসংখ্য পত্রিকা। আমাদের কিছু উৎসাহী শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমি কিছুদিন ‘ত্রৈমাসিক আলোকপত্র’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলাম। সেখানে মনজুর স্যারের পূর্বে প্রকাশিত কিছু লেখা পুনঃপ্রকাশ করি। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।

প্রায় সপ্তাহখানেক আগে এক সকালে দেখলাম, আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক আজফার হোসেন ও অধ্যাপক ফখরুল আলম স্যারের প্রায় অভিন্ন একটি পোস্ট। মনজুর স্যার অসুস্থ এবং তাঁর ‘বি নেগেটিভ’ রক্তের প্রয়োজন। পোস্টটিতে প্রচুর প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য দেখে আমার মনে হলো, রক্তের সংকট হবে না। ভাবলাম, হয়তো অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাই রক্তের প্রয়োজন। পাশের কক্ষেই ছিলেন মোহীত স্যার। তাঁকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বিচলিত হলেন। স্ট্যাটাসে রক্তের জন্য একটি যোগাযোগের নম্বর ছিল। আমার মনে হলো, নম্বরটি আগ্রহী রক্তদাতাদের যোগাযোগের জন্য ব্যস্ত থাকবে। মোহীত স্যারকে বললাম মনজুর স্যারের নম্বরে ফোন করতে। তাঁর ফোন নিশ্চয়ই কোনো নিকটজনের হাতে থাকবে। তিনি ফোন দিলেন। এক ভদ্রলোক জানালেন, স্যারের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ল্যাবএইড হাসপাতালে তাঁকে দুটি স্টেন্ট পরানো হয়েছে। যেহেতু রক্তের গ্রুপটি দুর্লভ, তাই কোনো জরুরি অবস্থায় যেন সংকট তৈরি না হয়, সে জন্যই এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে।

আমার নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই কয়েকজনের হার্টে বাইপাস ও স্টেন্ট পরানো আছে। অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছিল, অবস্থা তেমন সংকটজনক নয়। এরপরই দেখলাম, তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। খুব বিষণ্ণ লাগল। এরই মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য বুলেটিন জাতীয় গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। ফিরে আসা না-আসার এমন দোলাচলের মধ্যে পাঁচ তারিখ সকালে স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি মেসেজ দিলাম। লিখেছিলাম, “স্যার, আমার মনে হচ্ছে, এই শারীরিক দুর্যোগ সাময়িক। আপনি এটি কাটিয়ে উঠবেন। আমাদের দোয়া ও শুভকামনা আপনার সঙ্গে রইল।” পরে দেখলাম, মেসেজটি তিনি আর দেখেননি। দেখার কথাও নয়। আমাদের এসএমআই স্যার হারিয়ে গেলেন।

মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে নিয়ে যাঁরা লিখেছেন এবং যাঁদের লেখা আমার ফিডে আসছে, তাঁদের অনেকের লেখা পড়েছি, পড়ছি। ভালো লাগলেই আমার ওয়ালে শেয়ার করেছি। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও কাজটি এখনো চলছে। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে এটাই সম্ভবত আমার সর্বোচ্চসংখ্যক শেয়ার। স্যার বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রেরণা হিসেবে। সাহস দেয়ার জন্য। আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ভালো থাকবেন স্যার, যেখানেই থাকুন।’

লেখক – চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

সীমান্তে ফের মাইন বিস্ফোরণ, মিয়ানমার নাগরিক নিহত- বাংলাদেশি আহত

This will close in 6 seconds

‘সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার বেঁচে থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়’

আপডেট সময় : ০২:৫৪:৪২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

‘উনিশ শ বিরানব্বই সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই আমার ইংরেজিতে অনার্স পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। কক্সবাজারের মত প্রান্তিক শহরে বড় হলেও ইংরেজি সাহিত্যের তৎকালীন খ্যাতিমান শিক্ষকদের অন্তত কয়েকজনের সম্পর্কে জানতাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ স্যারদের নাম তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইংরেজি বিতর্ক অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করতেন। মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে তাঁর চমৎকার ইংরেজি ও যুক্তিবাদী চিন্তার পরিচয় পেতাম। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরিতে ইংরেজি বিভাগের সেই সব গুণী শিক্ষকের বইপত্র পাওয়া যেত। স্কুলের বই বাদ দিয়ে আমার আগ্রহ ছিল তাঁদের লেখা পড়ার প্রতি। বলা বাহুল্য, অনেক কিছুই আমি বুঝতাম না, তবুও পড়তাম। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ‘অভিব্যক্তিবাদী নাটক’ নামের একটি বইয়ে তাঁর গুলশানের ‘ঝরোকা’ বাড়ির ঠিকানায় স্যারকে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলাম। জানিয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য পড়ার আগ্রহের কথা। কীভাবে ভালো ইংরেজি শেখা যায়, স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রকে তিনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চিঠির জবাব দিতে বিলম্ব করেননি। ইংরেজি বিভাগের কোন শিক্ষকের সাথে এটাই আমার প্রথম বোঝাপড়া।

ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। লিখতে বসেছি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার সম্পর্কে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পূর্বেই তিনি দেদীপ্যমান ও সুপরিচিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি, এই আফসোস নিয়েই পড়াশোনা এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি এফ. আর. হলে থাকি। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পর শুনলাম, ভাইভাতে এক্সটার্নাল হিসেবে আসছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। পরীক্ষা কমিটিতে আরও ছিলেন অধ্যাপক আবদুল ওয়াসীহ স্যার ও অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার স্যার। ‘মুখোমুখি বসিবার’ এই সুযোগ আমাকে আপ্লুত করার কথা ছিল, কিন্তু ফল হলো উল্টো। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। খুবই আতঙ্কিত বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার পড়াশোনা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারটা এবার ধরা পড়ে যাবে। মালির ঘাড়ে পড়া বলতে যা বোঝায়, আমার অবস্থা তখন ঠিক তা-ই। কোথাও পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। ওই পাহাড়ি ক্যাম্পাসে খুব অসহায় লাগছিল। কোথায় যাব, কী করব—এই ভাবতে ভাবতেই আমার ডাক পড়ল।

মোহাম্মদ আলী স্যারের কক্ষে ভাইভা চলছিল।
শুরু হলো কথোপকথন, ইংরেজিতে প্রশ্নবাণ। সিলেবাসে রিচার্ড শেরিডানের ‘দ্য রাইভালস’ নামে একটি কমেডি ছিল। নাটকের বিষয় হলো সামাজিক ভণ্ডামি ও প্রেমের ভুল-বোঝাবুঝি। সেখানে স্যার লুসিয়াস ও’ট্রিগার নামে একটি চরিত্র ছিল। চরিত্রটি নাটকের অন্যতম হাস্যকর ও স্মরণীয় অংশ, যা দর্শকদের হাসানোর পাশাপাশি সমাজের ভণ্ড প্রেমিকদের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও কাজ করে। মনজুর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “ট্রিগার মানে কী?” আমি বন্দুকের ট্রিগার চোখে দেখতে পেলেও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। চুপ করে রইলাম। স্যার আঙুল দিয়ে গুলি ছোড়ার মতো করে ট্রিগার টেনে দেখালেন। আমি তবুও চুপ। অবস্থা বেগতিক দেখে সরওয়ার স্যার এবং ওয়াসীহ স্যার আরও কয়েকটি সহজ প্রশ্ন করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। সে যাত্রায় ভাইভাতে টেনেটুনে পাস জুটেছিল।

এই ঘটনার প্রায় সাত-আট বছর পর আমি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। আমি একটি এনজিওতে ছিলাম। বলতে গেলে, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক মোহীত-উল-আলম স্যার আমাকে সাদাত জামান খানের মাধ্যমে একরকম পাকড়াও করেছিলেন। স্যারের দেওয়া সেই সম্মান আমি কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি, জানি না। স্যারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তখন শিক্ষকসংখ্যা ছিল অল্প, ছোট পরিসরে কাজ চলছিল। অধ্যাপক কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ স্যার তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মোহীত স্যার ঢাকা থেকে মনজুর স্যার এবং আরও কিছুদিন পর অধ্যাপক ফখরুল আলম ও অধ্যাপক কায়সার হক স্যারকে বিভাগে আনার চেষ্টা করছিলেন। এঁরা সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের, যাকে বলে তারকা শিক্ষক। তাঁরা প্রিমিয়ারে আসবেন, এটা আমি প্রায় অকল্পনীয়ই ভেবেছিলাম। দেখলাম, মনজুর স্যার সাড়া দিলেন। পরে বাকি দুজনও যুক্ত হলেন। মোহীত স্যার সাহিত্য সেমিনারের আয়োজন শুরু করলেন। প্রথম দিকে স্যাররা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন, মোহীত স্যার সভাপতিত্ব করতেন এবং অন্যরা আলোচক থাকতেন। আমরা শ্রোতা। ভালোই চলছিল। কিছুদিন পর আমার জন্য আরেক আতঙ্ক শুরু হলো। মনজুর স্যার, বিল্লাহ স্যার ও মোহীত স্যার আমাদের প্রবন্ধ উপস্থাপনে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন, যেন আমরা শ্রোতা থেকে লেখক ও বক্তা হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এরই মধ্যে পেয়ে গেছি। বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে সেমিনার বলতে তেমন কিছু দেখিনি। প্রিমিয়ারে এটাকে অনেকটা রুটিন কাজে পরিণত করা হচ্ছিল। মোহীত স্যার যখন প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন, তখন আমাদের আলোচনা ও সভাপতিত্ব করতে বলতেন। কত অবলীলায় যে স্যার এই আদেশ দিতেন, তা ভেবে অবাক হতাম। সেবার মোহীত স্যার প্রবন্ধ দিলেন, আলোচক ছিলেন বিল্লাহ স্যার, মনজুর স্যার ও (সম্ভবত) সাদাত জামান খান। আমাকে বললেন সভাপতিত্ব করতে। মনজুর স্যারের সামনে সেদিন কেমন বলেছিলাম, তা আজ মনে নেই। কিন্তু বিল্লাহ স্যার পরদিন আমাকে বলেছিলেন, “জসীম, গতকাল তুমি খুব ভালো বলেছ।” যাঁরা বিল্লাহ স্যারকে চেনেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন, এটা একটা বিরাট প্রশংসা। আমার মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব চলে এল।

মনজুর স্যার এক দিনের জন্য আসতেন। অনেক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাজ থাকত। সকালে ক্লাস নিয়ে বিকেলে সেমিনারে অংশগ্রহণ করে সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে যেতেন। আমি অনেকটা তাঁর প্রটোকল অফিসারের মতো কাজগুলো দেখতাম। মোহীত স্যার তাঁর আসা-যাওয়া, সেমিস্টার, ক্লাসের বিষয় নির্বাচন, রুটিন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগের কাজটি আমাকে দিয়ে করাতেন। বিনিময়ে তাঁকে আমরা যে পারিশ্রমিক দিয়েছি, সত্যি বলতে কী, অনেক সময় আমি নিজেই লজ্জিত বোধ করেছি। বাংলাদেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কোর্স ও ক্লাস দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিকে সময় দেওয়াকে তিনি ‘ওয়ার্ক ফর লাভ’ বলতেন। কেবল মোহীত স্যার, বিল্লাহ স্যার ও সরওয়ার স্যারের টানেই তিনি এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ক্লাস ও সেমিনার ছাড়াও ইংরেজি বিভাগের প্রায় সব নিয়োগ, পদোন্নতি ও সিলেবাস প্রণয়নের কাজে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকতেন।

মনজুর স্যার খুব সহজেই জুনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এটি তাঁর একটি অসাধারণ গুণ ছিল। নাম ধরে ডাকতেন। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যুক্ত করতেন। ছোটকেও তিনি বড় করে দেখতেন বলেই আমার মতো মুখচোরা ছাত্রও স্যারের সঙ্গে সহজ হতে পেরেছিল। এমনকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তিনি অনেক সময় বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। তাঁর মধ্যে কৌতুকবোধ ছিল। খুব নিচু স্বরে কথা বলতেন। কাজের ফাঁকে নানা রকম মন্তব্য করতেন। খাবারের টেবিলে হালকা চালে অনেক কথা বলতেন। খুব পরিমিত খাবার খেতেন। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, বলতে গেলে তিনি কিছুই খেতেন না। সে কারণেই সম্ভবত খুব ছিমছাম ছিলেন। তাঁর সমবয়সীদের তুলনায় তিনি শারীরিকভাবে অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিলেন। ভুঁড়ি খুব অপছন্দ করতেন। কারও ভুঁড়ি থাকা মানে, তিনি বলতেন, লোকটির আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। কৌতুক করে ‘মধ্যপ্রদেশ’ সম্পর্কে সচেতন হতে বলতেন।

যা বলছিলাম, মোহীত স্যারকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি তাঁকে মোহীত স্যারের সমবয়সী ভাবতাম। পরে জানলাম, তিনি আমাদের বিল্লাহ স্যারের ব্যাচমেট এবং মোহীত স্যারের বছর দুয়েকের সিনিয়র। প্রিমিয়ারে এসে দেখলাম, তিনি মোহীত স্যারকে খুব স্নেহ করেন, অনেকটা বড় ভাইয়ের মতো। একবার কী একটা বিষয়ে বললেন, ‘মোহীত খুব কাজের ছেলে, ও পারবে।’ লেখক, কবি ও অধ্যাপক মোহীত-উল-আলমকে কেউ ‘ছেলে’ বলতে আমি সেদিনই প্রথম শুনলাম। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটি বিষয় নিয়ে মনজুর স্যারকে খুব রেগে যেতে দেখলাম। আমাকে বললেন, “তুমি তাদের বলে দিয়ো, মোহীত না থাকলে আমরা এখানে আসব না।” শুনতে আবেগি মন্তব্য মনে হলেও স্যার খুব চিন্তাভাবনা করেই কথাটা বলেছিলেন।

শিক্ষক, লেখক, সমালোচক, চিন্তক—যেভাবেই দেখি না কেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার ছিলেন ভালোর মধ্যে আরও ভালো। ভালো ছাত্র ভালো শিক্ষক হবেই, এমন কোনো কথা নেই। তিনি যত ভালো ছাত্র ছিলেন, তার চেয়ে ভালো শিক্ষক ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে অনেকেই ভালো পড়াতে পারেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। নিজ বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ইংরেজি পড়িয়েছেন, লিখেছেন, কিন্তু বাংলায় ছিলেন আরও ভালো। সাহিত্য সমালোচনা ছিল তাঁর পছন্দের জায়গা। দুর্বোধ্য বিষয়টি অনায়াসে আয়ত্ত করেছিলেন বলে শ্রেণিকক্ষে তা আরও সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। চিত্র সমালোচক হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মিডিয়ায় তিনি সেলিব্রিটি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন অসংখ্য পত্রিকা। আমাদের কিছু উৎসাহী শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমি কিছুদিন ‘ত্রৈমাসিক আলোকপত্র’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলাম। সেখানে মনজুর স্যারের পূর্বে প্রকাশিত কিছু লেখা পুনঃপ্রকাশ করি। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।

প্রায় সপ্তাহখানেক আগে এক সকালে দেখলাম, আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক আজফার হোসেন ও অধ্যাপক ফখরুল আলম স্যারের প্রায় অভিন্ন একটি পোস্ট। মনজুর স্যার অসুস্থ এবং তাঁর ‘বি নেগেটিভ’ রক্তের প্রয়োজন। পোস্টটিতে প্রচুর প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য দেখে আমার মনে হলো, রক্তের সংকট হবে না। ভাবলাম, হয়তো অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাই রক্তের প্রয়োজন। পাশের কক্ষেই ছিলেন মোহীত স্যার। তাঁকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বিচলিত হলেন। স্ট্যাটাসে রক্তের জন্য একটি যোগাযোগের নম্বর ছিল। আমার মনে হলো, নম্বরটি আগ্রহী রক্তদাতাদের যোগাযোগের জন্য ব্যস্ত থাকবে। মোহীত স্যারকে বললাম মনজুর স্যারের নম্বরে ফোন করতে। তাঁর ফোন নিশ্চয়ই কোনো নিকটজনের হাতে থাকবে। তিনি ফোন দিলেন। এক ভদ্রলোক জানালেন, স্যারের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ল্যাবএইড হাসপাতালে তাঁকে দুটি স্টেন্ট পরানো হয়েছে। যেহেতু রক্তের গ্রুপটি দুর্লভ, তাই কোনো জরুরি অবস্থায় যেন সংকট তৈরি না হয়, সে জন্যই এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে।

আমার নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই কয়েকজনের হার্টে বাইপাস ও স্টেন্ট পরানো আছে। অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছিল, অবস্থা তেমন সংকটজনক নয়। এরপরই দেখলাম, তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। খুব বিষণ্ণ লাগল। এরই মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য বুলেটিন জাতীয় গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। ফিরে আসা না-আসার এমন দোলাচলের মধ্যে পাঁচ তারিখ সকালে স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি মেসেজ দিলাম। লিখেছিলাম, “স্যার, আমার মনে হচ্ছে, এই শারীরিক দুর্যোগ সাময়িক। আপনি এটি কাটিয়ে উঠবেন। আমাদের দোয়া ও শুভকামনা আপনার সঙ্গে রইল।” পরে দেখলাম, মেসেজটি তিনি আর দেখেননি। দেখার কথাও নয়। আমাদের এসএমআই স্যার হারিয়ে গেলেন।

মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে নিয়ে যাঁরা লিখেছেন এবং যাঁদের লেখা আমার ফিডে আসছে, তাঁদের অনেকের লেখা পড়েছি, পড়ছি। ভালো লাগলেই আমার ওয়ালে শেয়ার করেছি। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও কাজটি এখনো চলছে। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে এটাই সম্ভবত আমার সর্বোচ্চসংখ্যক শেয়ার। স্যার বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রেরণা হিসেবে। সাহস দেয়ার জন্য। আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ভালো থাকবেন স্যার, যেখানেই থাকুন।’

লেখক – চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।