বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থেকে অনুমানিক ১৩ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে আশারতলি সীমান্ত। সদর থেকে একটু এগিয়ে গেলে শুরু হয় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। যেখানে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকার একটি পাহাড়ের ওপর বিজিবির আশারতলি বিওপির অবস্থান। সেখানে সম্প্রতি দেখা মিলে নানা বয়সী মানুষের। এর মধ্যে রয়েছে মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানো অন্তত ১৬ জন। যারা এখন চিরতরে পঙ্গু।
এসময় কথা হয় নুরুল আবছারের সঙ্গে। বয়স এখনও ১৮ হয়নি। সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে
সে হারিয়েছে তার ডান পা। স্ক্র্যাচের ওপর ভর করে চলাফেরা করতে হয়। নাইক্ষ্যংছড়ির জারুলিয়াছড়ি সীমান্ত এলাকায় বসবাস তার। সে জানায়, স্থানীয় এক ব্যক্তির শ্রমিক হিসেবে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে গরু আনতে গিয়ে এক বছর আগে মাইন বিস্ফোরণে পা হারায়। শ্রমিক হিসেবে সামান্য মজুরির আশায় সীমান্তে গিয়ে এখন চিরতরে পঙ্গু। ঘটনার পর যে ব্যক্তির হয়ে গরু আনতে গিয়েছিল তিনি আর খবর নেননি। বিজিবির পক্ষে কিছু নগদ অর্থসহ বিভিন্নভাবে তাকে সহায়তা করছে।
আরেক ভুক্তভোগী রামু উপজেলার গর্জনিয়ার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ। এক বছর আগে সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে হারান দুই পা। তিনিও সারা জীবনের জন্য পঙ্গু। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো মানুষ যেন ভুলেও আর সীমান্তে না যায়। এটা আশেপাশের লোকজনকে এখন বলি। আমি ভুল করেছি, অন্যরা যেন ভুল না করেন।’
মাইন বিস্ফারণে পঙ্গুদের গল্প কম-বেশি প্রায় একই রকম। এদের কেউ মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে গরু, কেউ সিগারেট, কেউ মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য আনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর বিনিময়ে প্রতি গরু বাবদ ২ হাজার টাকা থেকে পণ্য অনুযায়ী মজুরি প্রদান করা হতো তাদের।
বিজিবির বিওপিতে ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ শিরোনামে মাইন বিস্ফোরণ রোধে সীমান্তে না যাওয়ার প্রচারণা কর্মসূচিতে সবাই জড়ো হয়েছিলেন। এদিন বিজিবির মেডিকেল ক্যাম্পে স্থানীয়দের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি স্কুল শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণ।
কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস কে এম কফিল উদ্দিন কায়েস, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী ।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস কে এম কফিল উদ্দিন কায়েস বলেন, ‘নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবির আওতাধিন সীমান্ত এলাকায় ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যস্ত মাইন বিস্ফোরণে ১৬ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৩ জন, ২০২৪ সালে ৩ জন এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১০ জন আহত হয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে গত এক মাস ধরে বিজিবির পক্ষে ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ শিরোনামে মাইন বিস্ফোরণ হতাহত রোধে সচেতনতা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ প্রচারণার পর মানুষ এখন সীমান্তে যাওয়া কমিয়েছে। ফলে এক মাসে নতুন করে আহতের ঘটনা ঘটেনি।’
তিনি বলেন, ‘অবৈধ পণ্য আনা-নেয়ার নেপথ্যে গডফাদারদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সীমান্তে নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত শাহীন ডাকাতসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে। অন্যদের ধরার চেষ্টা চলছে।’
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম, সচেতন মানুষের সংখ্যাও কম এবং শিক্ষার হারও কম। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
আশারতলি সীমান্ত দিয়ে জামছড়ি দুই কিলোমিটার দূরে। আর জামছড়ি থেকে লেম্বুছড়ি সীমান্ত ৯ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু এক দূর্গম এলাকা। যেখানে সীমান্ত সড়কের পাশে দেখা মিলেছে বানর, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর চলাফেরা। এই ১১ কিলোমিটারের কিছু দূরে দেখা মিলে বিজিবির বিশেষ চৌকি, যেখানে ১২ ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টায় সর্তক অবস্থানে দায়িত্ব পালন করেন বিজিবি সদস্যরা। দেখা মিলে এপিসি যানসহ বিশেষ টহলের। আর এই দুর্গম পাহাড়ের সীমান্তের কিছু দূর যেতে দেখা যায় লাল পতাকা এবং সর্তকতামূলক বিলবোর্ড।’
জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির সহকারী পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, ‘সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে লাল পতাকা স্থাপনের মাধ্যমে সর্তকবার্তা জারি করা হয়েছে। যেখানে মাইন পুঁতে রাখার তথ্য রয়েছে। ১১ কিলোমিটার এলাকা ৩০ ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে শনাক্ত করা হয়েছে। সব স্থানেই লাল পতাকা উড়ানো হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পথ রোধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি যেন মানুষ না যান এজন্য বিজিবি এখন আগের চেয়ে কঠোর। ফলে এক মাসে হতাহত নেই।’