২০২৪ সালের জুলাই মাসের প্রচন্ড গরমে যখন সারা দেশ ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে, তখন বাংলাদেশের তরুণেরা, আমিও ছিলাম তাদের একজন, নিঃশব্দে প্র¯‘তি নি”িছলাম এক অসাধারণ প্রতিবাদের জন্য। জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা কিছু নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের প্রতি ক্ষোভে, আমরা ছাত্ররা আমাদের আঙুল আর স্মার্টফোনকে প্রতিবাদের হাতিয়ার বানিয়ে তুলেছিলাম। কয়েকটা এলোমেলো মেসেজ দিয়ে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন, তা অচিরেই রূপ নেয় সাইবার-বিদ্রোহে কয়েক দিনের মধ্যেই রাস্তা ছিল আমাদের দখলে।
সোশ্যাল মিডিয়াই ছিল আন্দোলনের হৃদস্পন্দন। ফেসবুক, ইনস্টগ্রাম, আর এক্স (টুইটার)-এ #WeWantJustice, #StudentPower2024, #QuotaReformMovement, #NoMoreSilence
এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের প্রান্তিক কলেজ আর স্কুল পর্যন্ত। ইনস্টাগ্রামের স্টোরিগুলো যেন হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের বিলবোর্ড, যেখানে লেখা ছিল “ALL EYES ON BANGLADESHI STUDENTS” এটা এমন কেউ ছিল না, যার প্রোফাইলে দেখা যেত না। আমি নিজেও যখন এই অনলাইন প্রতিবাদে অংশ নিই, তখন বুঝি এটা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মেসেঞ্জার গ্রæপগুলো হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের কমান্ড সেন্টার। যারা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সবসময় ‘উদাসীন’ বলে দোষারোপ করে, আমরা তাদের দেখিয়ে দিয়েছিলাম, আমরা কতটা সংযুক্ত আর কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আর একদিন হঠাৎ করেই ক্লিকগুলো রূপ নেয় পদচারণায়। ডিজিটাল ক্ষোভ পরিণত হয় বাস্তব প্রতিরোধে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে মানুষের শৃঙ্খল-স্কুল, সরকারি ভবন, আর ব্যস্ত সড়কের মোড়ে মোড়ে। পতাকা উড়তে থাকে। সরকারের তরফ থেকে আমাদের “রাজাকার” বলা হয়। তখনই এক দুর্দান্ত স্লোগানে গর্জে ওঠে “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার! রাজাকার!”
প্রথমে এই লড়াই ছিল কোটা সংস্কারের জন্য। পরে তা রূপ নেয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনে। “এক দফা, এক দাবি” এই আহ্বানে নতুন হ্যাশট্যাগ দেখা দেয় #StepDownHasina| । বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলো তখন আর কেবল ক্লাসের জন্য নয়- প্রতিবাদের স্পন্দনে কাঁপতে থাকে।
ছাত্ররা আয়োজন করে বসে থাকা কর্মসূচি, নীরব মিছিল, ফ্ল্যাশ মব, শহরজুড়ে বিক্ষোভ। যারা শহীদ হয়, যেমন চট্টগ্রামের আবু সায়েদ আর ওয়াসিম, তাদের সম্মানে প্রোফাইল পিকচারগুলো লাল রঙে রাঙানো হয়। সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছিল রিয়েল টাইমে— গ্রুপ মেসেজ আর লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে। রাস্তাগুলো কেবল বিক্ষোভকারীতে ভরা ছিল না, সেখানে ছিল স্বপ্নদ্রষ্টা, লড়াকু যোদ্ধা, ভবিষ্যতের নির্মাতা। কিন্তু‘ হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রধান আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হলে, অনেকে ধরে নিয়েছিল লড়াই শেষ।
ঠিক তখনই লন্ডন থেকে তারেক রহমানের একটি ভিডিও আসে- আশার বাণী নিয়ে। তিনি আমাদের বলেছিলেন, “হার মানো না।” এই ভিডিও আমাদের ভেতরে সাহস ফিরিয়ে দেয়। আবার ছড়িয়ে পড়ে বার্তা। কেউ কেউ বিপদের মুখে পড়া শিক্ষার্থীদের আগেই সতর্কবার্তা পাঠা”িছলো, কেউ আবার অপরিচিত ভাইদের মোবাইলে টাকা পাঠাচ্ছিলো, কেউ খাবার দি”িছলো। এমনকি একজন ভাই শহীদ হয় যখন সে পানি সরবরাহ করছিল- তার নাম মুগ্ধ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ন্যায়বিচারের দাবি এখন আন্তর্জাতিক মনোযোগও আকর্ষণ করে!
আমি ভয় পেয়েছিলাম- দেশটার জন্য, আমার পরিবারের জন্য, কিš‘ তবু হার মানিনি। আমি আমার বাবার সঙ্গে অনলাইনে চলা আন্দোলনের কথা বলতাম, তিনি বলতেন রাস্তায় কী হ”েছ। আমার আন্দোলনের প্রতি ভালোবাসা দেখে তিনি গর্ব করতেন। সেই মুহূর্তেই আমি বুঝেছিলাম- আমরা ইতিহাস গড়ে চলেছি। কিš‘ হঠাৎ, ২১ জুলাই রাতে, আমরা সবাই একসাথে খবর দেখছিলাম, এমন সময় আমার মায়ের ফোনে একটা কল আসে। ভয়ে তার ফোনটা পড়ে যায়। জানি আমার বাবা- একজন রাজনৈতিক নেতা- তাকে গ্রেপ্তার করেছে কক্সবাজার ডিবি পুলিশ।
সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে শুরু হয় এক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ- একদিকে ছোট ভাইদের আগলে রাখা, অন্যদিকে নিজেও তখনো একজন কিশোরী। মা সাহসী ছিলেন, কিš‘ আমি তার বড় মেয়ে হিসেবে দেখেছিলাম, তিনিও ভেঙে পড়েছিলেন। আমার ভাইরা যাতে কিছু বুঝতে না পারে, তার সব চেষ্টাই করেছিলাম। বাবার নির্দোষ তা জেনে আমার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। আমার স্বৈরতন্ত্রবিরোধী অব¯’ান আরও শক্ত হয়।
আমি রাস্তায় যেতে পারিনি, কারণ আমার মায়ের পাশে দাঁড়াতে হতো, ভাইদের সামলাতে হতো। কিš‘ আমি ঘরে থেকেই লড়েছি- বিদেশে থাকা বন্ধুদের বলেছি বার্তা ছড়াতে, পোস্টার বানিয়েছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের বার্তা দিয়েছি।
সরকার শুরুতে আমাদের আন্দোলনকে অস্বীকার করেছিল। এরপর ভয় পেয়েছিল, শেষে এসে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, যখন একটা আন্দোলন এতটা বিশাল, এতটা সংগঠিত, তখন তা আর অগ্রাহ্য করার সুযোগ থাকে না। প্রশ্নটা আর ছিল না “ছাত্ররা কিছু করতে পারে?” বরং সেটা হয়ে উঠেছিল, “এই ছাত্ররা কতটা বদল আনতে পারবে?”
শেষ পর্যন্ত হ্যাশট্যাগ বাস্তবতায় রূপ নেয়। ০৫ আগস্ট বাংলাদেশ মুক্ত হয়, আর ৬ তারিখ আমার বাবা। স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন- বা বলা ভালো, পালিয়ে যান। এমনটা কেউ কল্পনাও করেনি যে, দেশের দীর্ঘতম দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন শেষ হবে ছাত্রদের কারণে?
২০২৪ সালের এই ছাত্র আন্দোলন ছিল শুধুই প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল এক অনলাইন বিপ্লব- যেটি জন্ম নেয় সাহস, সংহতি আর ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে। এই বিপ্লব প্রমাণ করেছে, এখনকার যুগে একটা পোস্ট-ই হতে পারে একটি আন্দোলনের সূচনা, আর একটি প্রজন্ম উঠে দাঁড়াতে পারে- শুধু কথা বলার জন্য নয়, বরং শোনার জন্য।
আর আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়? এই আন্দোলনের আমি ছিলাম এক অংশ। আমি ছিলাম সেই লড়াইয়ের একজন সৈনিক- যে বদলে দিয়েছে আমাদের দেশকে।
লেখক: রামু ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কক্সবাজার এর নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী
তাজরিয়া বিনতে নেজাম এঞ্জেল 


















