মরিয়ম প্রতিদিনকার মাদ্রাসা গিয়ে আর ঘরে ফিরেনি। পথ হারিয়ে মরিয়ম যখন এদিক ওদিক যাচ্ছিলো ঠিক তখনই কে বা করা তাকে নিয়ে যায় কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনাল এলাকায়। সেখান থেকে মরিয়মের ভাগ্যে কি জুটল সেটা জানবো কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিনের ফেসবুকে দেয়া দীর্ঘ স্ট্যাটাসে।
লাল পরীর ঘরে ফেরা
২৯ অক্টোবর ২০২৫, সময়টা সন্ধ্যা ৬.৩০…..
অফিসে নিত্যদিনের মত কাজে ব্যস্ত, কর্মরত অফিসের একজন স্টাফ খালি পায়ের সবুজ জামা পড়া একটি ছোট্র মেয়েকে নিয়ে অফিস কক্ষে ঢুকে জানালেন –
একজন লোক মেয়েটিকে আমাদের অফিসে দিয়ে বলে গেলেন মেয়েটিকে বাস টার্মিনাল হতে পেয়েছে,হারিয়ে গিয়েছে মেয়েটি।
আহারে কোন মায়ের কোল খালি হল–
কাছে ডাকলাম তাকে..
ভীরু চোখে তাকিয়ে কান্নারত কণ্ঠে মেয়েটি জানাল —
তার নাম মরিয়ম…বয়স ৮ বছর..সে চোখে ভাল দেখতে পায় না…মাদ্রাসায় থাকে সেখানেই পড়ে,আজ হঠাত মাদ্রাসা ছুটি দেওয়ায় তার মা তাকে নিতে আসতে পারে নাই…
এক লোক মাদ্রাসার সামনে থেকে তাকে বাড়ি পৌছে দিবে বলে কক্সবাজার এ বাস টার্মিনাল এ নিয়ে আসে,
এরপর সে আর কিছু জানে না, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে…
আরেকজন লোক তাকে এই অফিসে দিয়ে গিয়েছে,এখান থেকে নাকি বাড়ি যাওয়া যাবে…
মরিয়মের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম
“তার বাবা মারা গিয়েছেন,
জন্মদাত্রী মা ও অন্ধ, বড় এক ভাই সে ও অন্ধ, এক বোন আছে শুধু চোখে দেখে..অষ্টম শ্রেনীতে পড়ে,সে ই রান্না করে-সংসার সামলায়…
তার মাকে সরকারী ঘর দেওয়া হয়েছে, গত শীতে সরকারী লোক গিয়ে কম্বল ও দিয়েছে…তার মা অন্ধ ভাতা পায়…”
এরকম আরও ছোট ছোট বিভিন্ন তথ্যাদি একত্রিত করে বুঝা গেল তার বাড়ি ঈদগাওয়ের পোকখালী এলাকায়..
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঈদগাও এর সাথে যোগাযোগ কর হল,মরিয়াম এর দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে খোজ খবর নিতে অনুরোধ জানালাম।
একই সাথে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার,সদর ও অন্ধপ্রতিবন্ধীদের তথ্যাদির মধ্যে মরিয়মের বাড়ির ঠিকানা খুজতে লাগল।
প্রচেষ্টা সার্থক হল- তার বাড়ির ঠিকানা পাওয়া গেল, ইউএনও ঈদগাও ওর সহায়তায় তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করা হল,মেয়ে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা গ্রাম পুলিশ কে নিয়ে রাতেরআধার ভেদ করে কিছুক্ষনের মধ্যেই রওনা হবেন তাকে নিয়ে যেতে..
চা নাস্তা খাওয়ার মাঝে মলিন মুখে মরিয়ম
জানাল সে জন্মান্ধ নয়..
ছোটবেলায় চোখে আরও ভালো দেখত, কিন্তু টাকার অভাবে কখনও ডাক্তার দেখানো হয়নি…
এ কথা শুনেই অফিস কক্ষে উপস্থিত উপজেলা কৃষি অফিসার রাসেল ও সমাজকর্মী সুজন সহ
কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতালের ডা. বিমল চৌধুরির সাথে যোগাযোগ করে তখনই মরিয়ম কে নিয়ে ওনার চেম্বারে গেলাম।
অত্যন্ত মানবিক মানুষটি বিনা ফিতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পাওয়ার অনুয়ায়ী চশমা দিলেন যাতে মরিয়ম আগের চেয়ে বেশ স্পষ্ট করে দেখতে পেলেও পুরোপুরি স্পষ্ট দেখবে না,আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করে দিলেন।
মরিয়মকে চশমা এবং এক মাসের প্রয়োজনীয় ওষধ কিনে দেওয়া হল….
মরিয়ম চশমা পরে হেসে উঠল—
“এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভাল দেখি….. ”
সেই হাসি— সেই হাসিতেই যেন সূর্য উঠল ঘরভর্তি অন্ধকারের ভেতর।
তারপর তার খালি পায়ে নুতন জুতার জন্য আমরা তাকে নিয়ে গেলাম মার্কেটে.. তার পছন্দে সবুজ রংয়ের আর একটি খয়েরী রংয়ের নতুন জুতো কেনা হল…
খুশী মনে সে আমার হাত ধরে হাটতে লাগল…
মরিয়মকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার প্রিয় রং কী?”
মুচকি হেসে চোখে মায়া ভরে বলল, “হলুদ।”
কিছুক্ষন পর তাকে একটি হলুদ জামা উপহার দিলে সে জানাল-
,” আমি লাল পরী হতে চাই… লাল জামা, লাল চুড়ি, লাল লিপস্টিক, মাদ্রাসায় পড়ি তাই লাল ওড়নাও লাগবে…!”
তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আমরা
তাকে নিয়ে গেলাম মেগামার্ট শপিং মলে…
সেখানে গিয়ে এত বড় দোকান এবং পুতুলের গায়ে পড়ানো পোষাক দেখে ছোট্ট কৌতুহলি মন ভীষন অবাক হল—–
কাছে গিয়ে পুতুলকে ছুঁয়ে দেখে নিষ্পাপ প্রশ্ন করে
“এরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কেমন করে?
অবশেষে এই ড্রেস সেই ড্রেস দেখে তার পছন্দসই লাল ফ্রক, লাল চুড়ি, লাল ওড়না,লাল লিপস্টিকে …চোখভরা আনন্দ নিয়ে লাল পরী সাজল পথ হারানো ছোট্র মরিয়ম।
এর মধ্যেই তার মা এবং বোন গ্রাম পুলিশ এবং একজন প্রতিবেশীসহ আমাদের অফিসে পৌছে গেছেন।
মরিয়ম কে নিয়ে আমার অফিস কক্ষে পৌছানোর পরই মরিয়ম তার মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পরে…
তার মায়ের অন্ধ চোখে তখন মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু, মুখে স্বর্গীয় হাসি….
মরিয়মের সে কি বাধভাংগা উচ্ছাস আর অনাবিল হাসি….
মরিয়ম তার মাকে জানাল “চশমা পরে সে আগের চেয়ে ভাল দেখতে পায়,কিন্ত পুরোপুরি দেখে না…”
সে তার মায়ের হাতটা নিয়ে ছুয়ে দিয়ে দেখাল সে লাল পরী জামা পড়েছে, সবুজ জুতা পড়েছে,
হলুদ পরী জামাটা আর খয়েরী জুতাটা সামনের ঈদের জন্য রেখে দিবে….আরও কত কথা….
মা মেয়ের এই পুর্নমিলনে উপস্থিত আমাদের সকলের চোখও অশ্রুসিক্ত হল….
এবার বিদায়ের পালা, মরিয়ম সারাক্ষন আমার হাত ধরে রইল…
নিচে নেমে সিএনজিতে বিদায় দেওয়ার সময় মরিয়ম জানাল এই গাড়িটার রং তার জামার রংয়ের মতই লাল,তাই তাকে গাড়ির সাথে তাকে একটা ছবি তুলে দিতে হবে…
রাত ১০ টায় লালপরী তার ঘর অভিমুখে রওনা হল……
নিজস্ব প্রতিবেদক : 














