কিয়েভের একটি ‘স্থায়ী’ শান্তি প্রয়োজন যা ভবিষ্যতে রাশিয়া ‘ধ্বংস’ করতে পারবে না। প্রায় তিন বছর ধরে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার করতে প্যারিসে মিলিত হওয়ার সময় নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই কথা জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তথ্য জানান তিনি। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি খবর জানিয়েছে।
এর আগে, ট্রাম্প অবশ্য বলেছিলেন, জেলেনস্কি একটি ‘চুক্তি’ করতে আগ্রহী এবং আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই জুটি একদিন আগে, এলিসিতে ফরাসি নেতা ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
ট্রাম্প গর্ব করে বলেছেন, এই সংঘাতের দ্রুত অবসান ঘটাতে পারেন তিনি। তবে, ট্রাম্প কীভাবে তা করতে পারেন সেটি স্পষ্ট করেননি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মারাত্মক আক্রমণ ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বকে আরও প্রসারিত করছে। এর মধ্যেই মস্কো ও কিয়েভ হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের অভিষেকের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমি বলেছি, আমাদের একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তি দরকার যা রাশিয়া কয়েক বছরের মধ্যে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে না, যেমনটি অতীতে তারা বারবার করেছে।’
প্রায় তিন বছরের যুদ্ধ ইউক্রেনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অন্য কারও চেয়ে বেশি শান্তি চায় ইউক্রেনীয়রা। রাশিয়া আমাদের ভূমিতে যুদ্ধ ডেকে এনেছে এবং রাশিয়াই শান্তির সম্ভাবনাকে সবচেয়ে বেশি ব্যাহত করতে চায়।’
তিনি পশ্চিমা মিত্রদের ‘দখলদারিত্বের দিকে অন্ধ না হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কিয়েভ শুধু এমন একটি চুক্তিতেই সম্মত হবে যা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনবে। জেলেনস্কি বলছিলেন, ‘যুদ্ধ চিরস্থায়ী হতে পারে না। শান্তি স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে।’
একটি বিরল স্বীকারোক্তিতে জেলেনস্কি বলেছেন, এই যুদ্ধে দেশটির ৪৩ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন।
এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই সংখ্যা অনেক বেশিই।
‘প্রধান শর্ত’
শান্তি আলোচনাটি কেমন হতে পারে এর মূল দিকগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও বিবরণ দেননি জেলেনস্কি। তবে একজন সিনিয়র ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করার জন্য তারা ‘কিছু মূল শর্ত’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সূত্রটি বলেছে, ‘আমরা বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করছি না। তবে বৈঠকে ট্রাম্প ও জেলেনস্কি উভয় বলেছেন, এমন কিছু হওয়া উচিত যা শান্তির নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করবে।’
এদিকে, ক্রেমলিন অভিযোগ করেছিল, ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনা করতে ‘অস্বীকৃতি’ জানিয়েছে। দেশটি বলেছে, শান্তি আলোচনায় প্রবেশের জন্য এর শর্তগুলোর মধ্যে কিয়েভের চারটি অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি অপরিবর্তিত রয়েছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ সেটি এবং আলোচনা প্রত্যাখ্যান করছে।’
২০২২ সালের একটি ইউক্রেনীয় ডিক্রির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি, যেটি পুতিনের সঙ্গে আলোচনার প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এর আগে, ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ ও আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক জীবন অকারণে নষ্ট হচ্ছে, অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনটি চলতে থাকলে এটি আরও বড় ও আরও খারাপ কিছুতে পরিণত হতে পারে।’
পুতিনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেন ট্রাম্প।
যুদ্ধে কতদিন চলতে পারে?
কিয়েভ, মস্কো ও প্যারিসে নেতারা বিবৃতি দিলেও পূর্ব ইউক্রেনের পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। রবিবার মস্কো ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় আরও একটি গ্রাম দখলের দাবি করেছে, ডোনেস্ক অঞ্চলের ব্লাগোদাত্ন।
ইউক্রেনের অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণ করলে কিয়েভকে রাশিয়াকে বঢ় ধরনের ছাড় দিতে বাধ্য করবে। এদিকে, যুদ্ধ দেখতে দেখতে এই জাতিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
পূর্ব খারকিভ অঞ্চলের ওসিনোভো গ্রামের সামনের সারির অবশিষ্ট বাসিন্দাদের একজন মাইকোলা লিটভিনভ ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠকের খবরে কিছুটা আশা খুঁজে পেয়েছেন। বাড়ির উঠোনে বুনন করা শাকসবজি থেকে মাটি পরিষ্কার করতে করতে ৮০ বছর বয়সী লিটভিনভ বলেছিলেন, তিনি আশা করেছিলেন, বৈঠকটি আলোচনার মাধ্যমে সংঘাতের অবসান ঘটাতে সহযোগিতা করবে।
এএফপিকে তিনি বলেন, ‘আমরা আর কতদিন যুদ্ধের মধ্যে থাকতে পারব? এত মানুষ নিহত হয়েছে, এত এত যুবক।’
তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, ইউক্রেন যদি ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় যেতো তবে আরও বেশি অঞ্চল ধরে রাখতে পারত। তবে লিটভিনভ আরও বলেন, অন্য একটি ব্যক্তিগত কারণেও লড়াইয়ের অবসান চাইছেন তিনি। তার ভাষ্যে, ‘আমার দুই সন্তানই যুদ্ধ করছে। আমি শুধু চাই, তারা জীবিত থাকুক।’
ইউক্রেন আরও বলেছে, ডোনেস্ক অঞ্চলে দুই বেসামরিক নিহত হয়েছে এবং দক্ষিণ খেরসন অঞ্চলে হামলায় আরও সাতজন আহত হয়েছে।