ঢাকা ০৮:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
স্বামীর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত খালেদা জিয়া জনজোয়ারে খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত ঢাকায় পৌঁছেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে ঢাকায় পাকিস্তানের স্পিকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জনতার ঢল সংসদ ভবনের পথে খালেদা জিয়ার মরদেহ কক্সবাজারে খালেদা জিয়ার শেষ সফর ছিলো ২০১৭ সালে থার্টি ফার্স্টে লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম হবে: মানতে হবে পুলিশী নির্দেশনা, বার বন্ধ থাকবে শোক পালন: সাগরতীরের তারকা হোটেলগুলোতে থার্টি-ফার্স্টের আয়োজন বাতিল চকরিয়ায় যুবদল নেতাকে পিটিয়ে হত্যা রুমিন ফারহানা-নীরবসহ ৮ জনকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার থার্টি ফার্স্ট নাইট:জেলা পুলিশের কঠোর বিধি-নিষেধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে যৌথ অভিযান কোস্টগার্ডের খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জাতিসংঘের শোক
রামু সহিংসতার ১৩ বছর

“মনে যে দাগ কেটেছে, তা মুছবে কিভাবে?”

১৩ বছর আগে কক্সবাজারের রামুর আজকের রাতটা ছিল আগুন আর আতঙ্কে মোড়া। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, হঠাৎই ফেসবুকে ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অভিযোগ ঘিরে জ্বলে ওঠে সহিংসতা। মুহূর্তেই শত বছরের পুরোনো বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভস্মীভূত হয় ১২টি মন্দির, পুড়ে যায় অর্ধশতাধিক বাড়িঘর।

১৩ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু রামুর বৌদ্ধ পল্লীর মানুষদের মুখে প্রশ্ন, “বিচার হবে তো?”

“আজও সেই রাত মনে পড়লে ঘুম ভেঙে যায়”

রামুর বৌদ্ধপল্লীর বাসিন্দা দীপক বড়ুয়া, সেদিনের বিভীষিকা বর্ণনা করতে গিয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
তিনি বলেন, “মন্দিরে আগুন লাগার পর আমরা শিশুদের নিয়ে পালিয়েছিলাম। কে কারে সাহায্য করবে, সবাই প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছিল। আজও সেই রাত মনে পড়লে ঘুম ভেঙে যায়।”

তার সঙ্গে বসা আরেকজন স্থানীয় এক নারী বলেন, “আমাদের প্রজন্ম মন্দিরের পাশে বড় হয়েছে। সেই মন্দিরগুলোকে এক রাতেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো। অথচ এতদিনেও এর বিচার আমরা চোখে দেখতে পারলাম না।”

মামলা অনেক, বিচার নেই

হামলার পর রামু, উখিয়া ও টেকনাফে মোট ১৯টি মামলা হয়। এজাহারে নাম ছিল ৩৭৫ জনের; আর তদন্তে আসামি করা হয় আরও ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে।

কিন্তু তদন্ত শেষে মাত্র ১৮টি মামলায় অভিযোগপত্র জমা পড়ে ৯৪৫ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে অনীহা দেখা গেছে অনেক সাক্ষীর। অনেকে বলছেন ভয়, হুমকি আর প্রভাবশালীদের চাপ তাদের পিছিয়ে দিয়েছে।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন। সরকারি কৌঁসুলি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এত বছর পরও যদি বিচার না হয়, তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে স্থায়ী ভয় থেকে যাবে। তারা ভাববে, তাদের নিরাপত্তা বা অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের দায় নেই। বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে মামলার গতি হারিয়ে যাবে।”

স্থানীয়দের কণ্ঠে হতাশা

রামুর এক চায়ের দোকানে বসা প্রবীণ কৃষক ধনঞ্জয় বড়ুয়া বললেন, “আমাদের চোখের সামনে শত বছরের মন্দির পুড়ে গেল। এত মামলা হলো, কিন্তু আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে দিব্যি। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু শুনে যাচ্ছি, ‘বিচার চলছে’। কিন্তু শেষটা কবে হবে কেউ জানে না।”

উৎস বড়ুয়া, যিনি তখন স্কুল পড়ুয়া ছিলেন, এখন চাকরি করেন। তিনি বলেন, “বিচার যদি না হয়, তাহলে আমরা কী শিখব? ছোটবেলায় দেখেছি কিভাবে মন্দির পুড়েছে। এখন বড় হয়ে দেখছি বিচার হচ্ছে না। এটা সমাজে ভুল বার্তা দেয়।”

তদন্ত প্রতিবেদন ফাঁস, সাক্ষীদের ভয়

সরকারি পর্যায়ের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির একটি প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে সাক্ষীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। অনেকেই ভয়ে আদালতে যেতে চাননি। স্থানীয় বৌদ্ধ নেতাদের অভিযোগ, এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করেছে।

স্থানীয় এক বয়স্ক বাসিন্দা অমৃত বড়ুয়া বলেন, “আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম আদালতে গিয়ে সত্য বলব। কিন্তু যখন শুনলাম কারা কারা আসামি হয়েছে, তখন ভয় পেলাম। এদের অনেকে প্রভাবশালী, মুখ খুলি তো কালকেই বাড়িঘর আবার জ্বালিয়ে দেবে।”

একজন যুবক সাক্ষী, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বললেন, “তদন্তের রিপোর্ট ফাঁস হওয়ার পর থেকে আমরা হুমকি পাচ্ছি। রাতে অপরিচিত লোক এসে ভয় দেখায়। এমন পরিস্থিতিতে কে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেবে?”

আরেকজন নারী সাক্ষী ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, “আমাদের চোখের সামনে মন্দির জ্বালিয়ে দিল, ঘর ভেঙে দিল। অথচ ভয় আর হুমকির কারণে আমরা আদালতে গিয়ে কথাই বলতে পারি না। এটা কেমন বিচার?”

সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী অর্পণ বড়ুয়া মনে করেন, এই ভীতি ও সাক্ষীর অনুপস্থিতি মামলার অগ্রগতি ব্যাহত করছে এবং ন্যায়বিচারের সম্ভাবনাকে ক্রমেই ক্ষীণ করে দিচ্ছে।

রামুর ক্ষত আজও তাজা

১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষত শুকায়নি। নতুন করে মন্দির নির্মাণ হয়েছে, ঘরবাড়িও আবার উঠেছে। কিন্তু মানুষের মনে ভয় আর অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে।

স্থানীয় জয়া বড়ুয়া আক্ষেপ করে বললেন,“ঘরবাড়ি বানানো যায়, মন্দিরও বানানো যায়, কিন্তু মনে যে দাগ কেটেছে, তা মুছবে কিভাবে?”

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

This will close in 6 seconds

রামু সহিংসতার ১৩ বছর

“মনে যে দাগ কেটেছে, তা মুছবে কিভাবে?”

আপডেট সময় : ০৫:১৯:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৩ বছর আগে কক্সবাজারের রামুর আজকের রাতটা ছিল আগুন আর আতঙ্কে মোড়া। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, হঠাৎই ফেসবুকে ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অভিযোগ ঘিরে জ্বলে ওঠে সহিংসতা। মুহূর্তেই শত বছরের পুরোনো বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভস্মীভূত হয় ১২টি মন্দির, পুড়ে যায় অর্ধশতাধিক বাড়িঘর।

১৩ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু রামুর বৌদ্ধ পল্লীর মানুষদের মুখে প্রশ্ন, “বিচার হবে তো?”

“আজও সেই রাত মনে পড়লে ঘুম ভেঙে যায়”

রামুর বৌদ্ধপল্লীর বাসিন্দা দীপক বড়ুয়া, সেদিনের বিভীষিকা বর্ণনা করতে গিয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
তিনি বলেন, “মন্দিরে আগুন লাগার পর আমরা শিশুদের নিয়ে পালিয়েছিলাম। কে কারে সাহায্য করবে, সবাই প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছিল। আজও সেই রাত মনে পড়লে ঘুম ভেঙে যায়।”

তার সঙ্গে বসা আরেকজন স্থানীয় এক নারী বলেন, “আমাদের প্রজন্ম মন্দিরের পাশে বড় হয়েছে। সেই মন্দিরগুলোকে এক রাতেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো। অথচ এতদিনেও এর বিচার আমরা চোখে দেখতে পারলাম না।”

মামলা অনেক, বিচার নেই

হামলার পর রামু, উখিয়া ও টেকনাফে মোট ১৯টি মামলা হয়। এজাহারে নাম ছিল ৩৭৫ জনের; আর তদন্তে আসামি করা হয় আরও ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে।

কিন্তু তদন্ত শেষে মাত্র ১৮টি মামলায় অভিযোগপত্র জমা পড়ে ৯৪৫ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে অনীহা দেখা গেছে অনেক সাক্ষীর। অনেকে বলছেন ভয়, হুমকি আর প্রভাবশালীদের চাপ তাদের পিছিয়ে দিয়েছে।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন। সরকারি কৌঁসুলি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এত বছর পরও যদি বিচার না হয়, তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে স্থায়ী ভয় থেকে যাবে। তারা ভাববে, তাদের নিরাপত্তা বা অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের দায় নেই। বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে মামলার গতি হারিয়ে যাবে।”

স্থানীয়দের কণ্ঠে হতাশা

রামুর এক চায়ের দোকানে বসা প্রবীণ কৃষক ধনঞ্জয় বড়ুয়া বললেন, “আমাদের চোখের সামনে শত বছরের মন্দির পুড়ে গেল। এত মামলা হলো, কিন্তু আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে দিব্যি। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু শুনে যাচ্ছি, ‘বিচার চলছে’। কিন্তু শেষটা কবে হবে কেউ জানে না।”

উৎস বড়ুয়া, যিনি তখন স্কুল পড়ুয়া ছিলেন, এখন চাকরি করেন। তিনি বলেন, “বিচার যদি না হয়, তাহলে আমরা কী শিখব? ছোটবেলায় দেখেছি কিভাবে মন্দির পুড়েছে। এখন বড় হয়ে দেখছি বিচার হচ্ছে না। এটা সমাজে ভুল বার্তা দেয়।”

তদন্ত প্রতিবেদন ফাঁস, সাক্ষীদের ভয়

সরকারি পর্যায়ের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির একটি প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে সাক্ষীদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। অনেকেই ভয়ে আদালতে যেতে চাননি। স্থানীয় বৌদ্ধ নেতাদের অভিযোগ, এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করেছে।

স্থানীয় এক বয়স্ক বাসিন্দা অমৃত বড়ুয়া বলেন, “আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম আদালতে গিয়ে সত্য বলব। কিন্তু যখন শুনলাম কারা কারা আসামি হয়েছে, তখন ভয় পেলাম। এদের অনেকে প্রভাবশালী, মুখ খুলি তো কালকেই বাড়িঘর আবার জ্বালিয়ে দেবে।”

একজন যুবক সাক্ষী, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বললেন, “তদন্তের রিপোর্ট ফাঁস হওয়ার পর থেকে আমরা হুমকি পাচ্ছি। রাতে অপরিচিত লোক এসে ভয় দেখায়। এমন পরিস্থিতিতে কে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেবে?”

আরেকজন নারী সাক্ষী ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, “আমাদের চোখের সামনে মন্দির জ্বালিয়ে দিল, ঘর ভেঙে দিল। অথচ ভয় আর হুমকির কারণে আমরা আদালতে গিয়ে কথাই বলতে পারি না। এটা কেমন বিচার?”

সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী অর্পণ বড়ুয়া মনে করেন, এই ভীতি ও সাক্ষীর অনুপস্থিতি মামলার অগ্রগতি ব্যাহত করছে এবং ন্যায়বিচারের সম্ভাবনাকে ক্রমেই ক্ষীণ করে দিচ্ছে।

রামুর ক্ষত আজও তাজা

১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষত শুকায়নি। নতুন করে মন্দির নির্মাণ হয়েছে, ঘরবাড়িও আবার উঠেছে। কিন্তু মানুষের মনে ভয় আর অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে।

স্থানীয় জয়া বড়ুয়া আক্ষেপ করে বললেন,“ঘরবাড়ি বানানো যায়, মন্দিরও বানানো যায়, কিন্তু মনে যে দাগ কেটেছে, তা মুছবে কিভাবে?”