বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ঘিরে আবর্তিত কক্সবাজারের পর্যটন। ভ্রমণে আসা পর্যটকদের আবাসন সেবায় এখানে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস-কটেজ। রয়েছে তিনশ’র বেশী রেস্তোরাঁ-কুলিং কর্ণার। এতসব প্রতিষ্ঠানের মাঝে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান (এসটিপি) রয়েছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি তারকা হোটেলে।
সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এ গেজেট অনুযায়ী সৈকতের বেলাভূমির নির্দিষ্ট এলাকায় স্থাপনা নিষিদ্ধ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা রিটের সূত্র ধরে ইসিএ-তে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। এরপরও প্রশাসনকে ম্যানেজ কিংবা ফাঁকি দিয়ে উঠছে দালান। চলমান স্থাপণাতেও হচ্ছে না এসটিপি!
ফলে, অপরিকল্পিত স্থাপণা ও ভয়াবহ দূষণের ঝুঁকিতে পড়েছে পর্যটন নগরী। মানবসৃষ্ট এসব দূর্যোগ থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে আবেদন দিয়েছে ‘উই ক্যান কক্সবাজার’ নামে একটি পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন। তারা ইসিএ আইন ও এসটিপি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের আন্তরিক কর্মতৎপরতা কামনা করেছেন।
সূত্র মতে, কক্সবাজার শহর হতে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সংলগ্ন এলাকায় ছোট-মাঝারি-বড় আবাসিক হোটেল রয়েছে পাঁচ শতাধিক। শুধু কলাতলী জোনে রয়েছে তিন শতাধিক হোটেল। এরমাঝে তারকা মানের চারটি হোটেলে নিজস্ব এসটিপি রয়েছে। বাকি তারকা হোটেলগুলোকে এসটিপি স্থাপনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। আর অন্যান্য ছোট-মাঝারি হোটেল গুলোর জন্য সেন্ট্রাল এসটিপি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উই ক্যান কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহি ওমর ফারুক জয় বলেন, নির্মল পরিবেশে প্রকৃতি উপভোগে কক্সবাজারে আসেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা। অসচেতনতা ও আইন অমান্য করার প্রবণতায় দূষিত হচ্ছে এখানকার পরিবেশ। যা পর্যটকদের মাঝে কক্সবাজার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। এক-দু’দশক আগে গড়া হোটেলে এসটিপি নেই, কিন্তু প্রশাসনিক তদারকিহীনতায় চলমান সময়ে গড়ে উঠা স্থাপণাতেও হচ্ছে না এসটিপি। ফলে, শহরের পরিবেশ দূষিত হয়েছে। ইসিএতে স্থাপণা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞায় গেজেট ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও কলাতলীর ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের পূর্বে লাগোয়া এবং মধ্যকলাতলীতে অসংখ্য স্থাপণা উঠছে। যার কোনটিতেই এসটিপি করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এতে ভয়াবহ দূষণে পড়ছে পর্যটন জোন।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের কর্মকর্তা দীপক শর্মা দিপু বলেন, নিষেধাজ্ঞায় স্থাপনা উঠছে সৈকত তীর জুড়ে। কোথাও মানা হচ্ছেনা পরিবেশ আইন। এসটিপি স্থাপন তো নেই-ই। এতে ধীরে ধীরে বাস অনুপযোগী হয়ে উঠছে পুরো শহর। তাই পরিবেশ ছাড়পত্রহীন ভবনগুলোর নির্মাণ বন্ধ করা প্রয়োজন। আর, যারা আগে নির্মাণ করেছে তাদের স্থাপনা পরিবেশবান্ধব করতে পুনঃসংস্কার জরুরি। সেইসঙ্গে এসটিপি বাধ্যতামূলক করা দরকার।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরাম সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করে। মানব-বর্জ্য এসটিপি ছাড়াই সাধারণ টয়লেট রিং-এ জমা হয়। সেখান থেকে যাচ্ছে নালায়। আর নালা থেকে সরাসরি যাচ্ছে স্থানীয় বাঁকখালী নদীতে। বাকঁখালী নদী হয়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। এসটিপি না থাকায় পর্যটন জোন নদী ও বঙ্গোপসাগর দূষিত হচ্ছে। এসব রোধে ইসিএ আইন মানা বাধ্যতামূলক করা জরুরী।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার জানান, পরিবেশ আইন না মেনে গড়ে উঠা পর্যটন শহরের সাড়ে তিনশ’র বেশি আবাসিক হোটেলকে এসটিপি স্থাপনের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে, অধিকাংশ হোটেলে এসটিপি স্থাপনের জায়গা নেই। তাই জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার পৌরসভা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে সেন্ট্রাল এসটিপি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসটিপি না থাকায় ভয়াবহ পবিবেশ দূষণের কবলে পড়েছে পর্যটন জোন। পয়ঃনিষ্কাশনের ময়লাপানি আসে নালায়। এতে পর্যটন এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যেসব তারকা হোটেলে এসটিপি নেই তাদের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একটি আইএনজিওর অর্থায়নে পৌরসভার তত্বাবধানে অন্য হোটেলগুলো নিয়ে কলাতলী জোনে সেন্ট্রাল এসটিপি করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। চলমান পরিস্থিতিতে পৌরপরিষদ বিলুপ্ত থাকায় তা অনগ্রসর। পৌরসভা এগুলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে কক্সবাজারে স্থাপনা উঠেছে। এখন যা হবে সব মাস্টারপ্ল্যান মোতাবেক। দূষণমুক্ত পর্যটন নগরী করতে এসটিপি বাস্তবায়ন এবং নির্দেশনা মতো নির্মাণাধীন ভবনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে, অন্তর্র্বতী সরকারের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বৃহস্পতিবার ঢাকায় গণমাধ্যমকে বলেন, সৈকত এলাকায় স্থাপণা তৈরি ও উচ্ছেদ অনেকটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের মতো হয়ে গেছে। প্রশাসন ভাঙে এবং দখলকারীরা আবার গড়ে। কক্সবাজারে জমি নিয়ে আগ্রাসন চলছে। পর্যটনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করে তিনি।