পর্যটন নগরী কক্সবাজার যেনো চুরি ছিনতাই সহ নিরাপদে অপরাধ করার উপযোগী স্থানে পরিণত হয়েছে। শহরজুড়ে বিরাজ করছে চুরি ছিনতাই আতঙ্ক। ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেল, অটোরিকশা (থ্রি-হুইলার) কিংবা সিএনজি যোগে এসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মোবাইল ফোন ,স্বর্ণালংকার,ভ্যানিটি ব্যাগ সহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পত্র টেনে হিচড়ে নিয়ে যায়। দিনের আলোতে এমন ছিনতাই হরহামেশাই ঘটছে কক্সবাজার শহরে। কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে, বিশেষ করে গভীর রাতে শহরের প্রধান সড়কগুলোর পাশাপাশি অলিগলির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ছিনতাইকারীদের হাতে। এসব ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে বলে দাবি করেন সামাজিক আন্দোলনের সংগঠকেরা।। কক্সবাজার শহর এমন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে চলন্ত যানবাহনে মুঠোফোন ব্যবহারও অনিরাপদ। বেশির ভাগ ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার হচ্ছে নাম্বারবিহীন মোটরযান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে ছিনতাই প্রতিরোধে কাজ করছে প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে জেলায় ১৪টি ডাকাতি মামলায় ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে ৪০টি দস্যুতা মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৪৯ জন। এছাড়া মানবপাচারের ১২টি মামলায় ১৫৮ জন ভিকটিম উদ্ধার করা হয়েছে। ১৪১টি চুরি ও ৪২টি সিধেঁল চুরির ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের আরেকটি প্রতিবেদনে জানা যায়, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারির ১৭ তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার সদর মডেল থানায় চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে ১৩ টি যার মধ্যে মাত্র ২৫ জন অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ( ১৬ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র নার্স অমিতা নাথ। শহরের জনবহুল এলাকা গোলদিঘির পাড়ে হয়ে যেতে হঠাৎ দুটি মোটরসাইকেল এসে তার গতিরোধ করে। মোটরসাইকেলে থাকা এক যুবক বলেন, “আপা আপনার চেইন খুব সুন্দর, আমার পছন্দ হয়েছে”। এটি বলতে না বলতেই ওই নারীর গলা থেকে টান দিয়ে চেইন ছিনিয়ে নেয়। এ সময় অনেক মানুষ হ্যা করে তাকিয়ে ছিলেন। এসময় প্রকাশ্যে চেইন ছিনিয়ে নিয়ে বীরদর্পে চলে যায় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় স্কুলের অভিভাবকসহ স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে ঘটে যায় আরো একটি দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনা। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে জানা যায় বিকেল বেলা পায়ে হেঁটে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যাচ্ছিলের খরুলিয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাইল(২৪)। এমন সময় পিছন থেকে অটোরিকশা (মিশুক) নিয়ে ৩ জনের একটি অস্ত্রধারী ছিনতাইকারী দল এসে একজন পেছন থেকে ছুরি ধরে, দুজন মোবাইল টাকা সহ সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায় এবং ব্যাপক মারধর করে। এসময় তার আশেপাশে থাকা ৫-৬ জন মানুষ তাকিয়ে ছিলেন।
অন্যদিকে, গত বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকাল ৬:৩০ টার দিকে কক্সবাজার শহরের পানবাজার এলাকার খবর বিতান রোডে এক বেসরকারি সংস্থার এক নারী কর্মীকে ছিনতাই ও মারধরের ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী বেসরকারি সংস্থার নারী কর্মীর সানজিদা ইয়াসিন জানান , সকালে স্ত্রী কর্মস্থলে যাওয়ার সময় আমার বাসা থেকে চোখের দুরত্বে খবর বিতান সড়কে তিনজন ছিনতাইকারী আমার স্ত্রীকে পেছন দিয়ে মুখ চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়ে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এরপর আমার বুকের উপর বসে গলায় ছুরি ধরে হাতে থাকা দুইটি স্বর্ণের আংটি ছিনিয়ে নেয় এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে আমি ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারায়।
শুধু কক্সবাজারের স্থানীয় নয় কক্সবাজার ভ্রমণ আসা পর্যটকেরাও পড়ছেন ছিনতাইকারীদের কবলে। গত বৃহস্পতিবার ( ৯ জানুয়ারি) কক্সবাজার শহরের ডিভাইন রিসোর্টের পাশে ছিনতাইয়ের শিকার হন ঢাকা থেকে আসা আবরাহাম ও তার তিন বন্ধু। তিন বন্ধু মিলে সৈকতে আড্ডা দিতে যান। ফেরার পথে ডিভাইন ইকো রিসোর্টের পাশে মাস্ক পরা পাঁচজন এসে ছুরির মুখে জিম্মি করে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। এর মধ্যে তুহিন নামে এক পর্যটকের পায়ে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র বলছে, বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের কলাতলী প্রাইমারি স্কুল, কলাতলী ডিভাইন রোড, সমুদ্রসৈকতের ঝাউবাগান, সৈকত পাড়া, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে, কটেজ জোন, হোটেল কল্লোলের সামনে, জাম্বুর মোড়, হাসপাতাল সড়ক, পেট্রোল পাম্প, পান বাজার, গোলদিঘীর পাড়ে কবরস্থান রোড, বৈদ্যঘোনা ১০ তলার বিল্ডিংয়ের সামনে, বৌদ্ধ মন্দির গেইট, জাদিরাম পাহাড়ের উপরে, ক্যাং মাঠে, মাইক সাভির্স রোড, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, খুরুশকুল পুরাতন ব্রীজ, বিজিবি ক্যাম্পের আম গাছ তলা ও বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিনতাইকারী চক্র দাপিয়ে বেড়ান। তারা সুযোগ বুঝে ছিনতাই সহ অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
এদিকে একের পর এক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকেই দুষছেন সচেতন মানুষেরা।
কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মুরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ইদানিং শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। পর্যটন স্পর্ট থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই যেনো নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জনবহুল পর্যটন এলাকায় ও খুনের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও ঘটেছে। যা শুধু আমাদেরকে শংকিত করেনি বরং পর্যটন শিল্পেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পরেছে।তাই যত দ্রুত সব বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেসব স্থানে সিসিটিভি ক্যামরাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে সে গুলো সংস্কার বা পরিবর্তন করা দরকার।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, গত ৪/৫ মাসের মধ্যে কক্সবাজার জেলাজুড়ে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। জেলা জুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে পুনরায় বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রতিনিয়ত খুন,অপহরণ,ছিনতাই, দখলসহ নানা অপরাধ এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে যৌথ বাহিনীর অভিযান জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন , পুরো কক্সবাজার শহর সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতো জেলা পুলিশ কিন্তু ৫ আগস্টের পর সিসিটিভি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ হারায় পুলিশ। গত দুই মাস আগে সিসিটিভি ক্যামেরা আবার সচল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদাপত্র জমা দিয়েছি। পাশাপাশি ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত ১৫ দিনে জেলা পুলিশ চুরি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় ১০৪ জনকে আটক করে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, কক্সবাজার পৌরসভার যেসব এলাকায় সড়ক বাতি জলে না তার জন্য কক্সবাজার পৌরসভার সাথে কথা হয়েছে। সেসব সড়ক বাতি সংক্রান্ত সমস্যা অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করা হবে। ইতোমধ্যে সমুদ্র সৈকত এলাকায় নষ্ট হওয়া ৪৯ টি ফ্লাটলাইট সংস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাব পুলিশের নিয়মিত টহল জোরদার করা হয়েছে বলেই দায় সারেন জেলা প্রশাসক।
কক্সবাজার আদালতের একটি সুত্র বলছে চুরি ছিনতাইয়ের ও ডাকাতির ঘটনায় আটক হওয়া অধিকাংশ অপরাধী অল্প দিন হাজতবাসে জামিন পেয়ে যায়। যার কারণে আটক অপরাধীরা জেল থেকে বের হয়ে আবারো একি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়েরা জজ আদালত-১ এর সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এড. দিদারুল মোস্তফা জানান, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আসামী তেমন একটা ধরা পড়ে না। একটি ছিনতাই সংগঠিত করে একাধিক অপরাধী তবে এর মধ্যে থেকে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না পারতে ধরে একজনকে অথবা দুজনকে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। অনেক চুরি ছিনতাই এর ঘটনায় কোন আসামি ধরা পড়ে না তখন মামলা গুলো আটকে থাকে।
দিদারুল মোস্তফা বলেন, আটক আসামীরা দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে এমন না, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। অনেক সময় চুরি ছিনতাই ঘটনায় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে এজাহারে সঠিক ভাবে অভিযোগ উঠে আসে না। আদালত মামলার মেরিট বিবেচনা অপরাধের ধরণ অনুযায়ী জামিন দেয়।এই বিষয়ে আমার বিশ্লেষণ হলো, মামলার যাবতীয় বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে অপরাধীরা এধরণের অপরাধ থেকে দুরে থাকতো। সে ক্ষেত্রে পুলিশকে আরো আন্তরিক হতে হবে।