মোহাম্মদ আয়াছুল আলম
বুধবার সকাল থেকেই স্বজনরা এসে ভীড় করছেন কক্সবাজার নুনিয়াছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে। গ্রীষ্মের রৌদ্র খরতাপ উপেক্ষা করে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা তাদের। এই স্বজনদের কারো ছেলে,কারো স্বামী আবার কারো বাবা দীর্ঘদিন ধরে বন্দি হয়ে আছেন মিয়ানমার কারাগারে। কেউ মাছ ধরতে গিয়ে ভুল করে বর্ডার ক্রস করে অবৈধ প্রবেশের দায়ে আটকা পড়েছেন, আবার কেউ বিদেশ গিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্নে দালালের খপ্পরে পড়ে আটকা পড়েছে বছরের পর বছর। হারানো প্রিয়জনদের ফিরে পেতে অনেকেই এসেছেন। তাদেরই একজন জুহুরা খাতুন। হাতে সযত্নে ফ্রেমে বাঁধানো সন্তানের ছবি। ছবির দিকে তাকিয়ে বলছেন,’ আমার ছেলে ফিরে পাবার আশায় এসেছিলাম, কিন্তু পাইনি। এখানে যারা এসেছে তারা তাদের ছেলেকে ফিরে পেয়েছে। শুধু আমার ছেলেকে পাইনি। কেউ আমার ছেলেকে খুঁজে দেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন তিনি।’
এই মায়ের বাড়ি কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়ার ছড়া। গত ১১ বছর আগে জুহুরা খাতুনের ছেলে আব্দুর রহিম সাগরে মাছ আহরণ করতে গিয়ে ভুলবশত মিয়ানমার সীমান্তে প্রবেশ করার অপরাধে তাকে আটক করে কারাগারে দেন মিয়ানমার সরকার।
গত ৫ বছর আগে কক্সবাজার সদর মডেল থানা থেকে এমন খবর পান বলে জানান তিনি। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও তার ছেলেকে মিয়ানমার কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারেননি তিনি।
তাই জুহুরা খাতুন ছেলে ফিরে পাবার আশায় মিয়ানমার কারাগার থেকে ১৭৩ বাংলাদেশি ফেরত আনার খবর পেয়ে ছুটে যান জেটিঘাটে। কিন্তু জুুহুরা বেগমের আশায় গুড়ে বালি। ছেলেকে না পেয়ে হতাশ হন তিনি। তাই অঝোর নয়নে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এই মা।
শুধু জুহুরা খাতুন নয়, শহরের বাঁকখালী নদীর বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে ১৭৩ বাংলাদেশিকে আনার খবরে প্রিয়জনদের খুঁজে অনেক স্বজনই এসেছেন। কেউ কেউ প্রিয়জনদের ফিরে পেলেও অনেকেই খুঁজে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন।
এমন আরেকজন মা টেকনাফের হ্নীলার বাসিন্দা হাসিনা আক্তার । একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ সোহেলকে হারিয়েছেন তিনি। হাসিনা আক্তার জানান, ‘দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন তার ছেলে। খবর পেয়েছেন ছেলে মিয়ানমার কারাগারে বন্দি। তাই মিয়ানমার থেকে ১৭৩ জনের মধ্যে সোহেল আসবেন, সেই আশায় অধীর অপেক্ষায় ছিলেন তিনিও। কিন্তু ছেলে ফিরলেন না।’ কান্না জড়িত কন্ঠে হাসিনা জানান, ‘সন্তানকে ফিরে পেতে দালালকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। দালাল টাকা খেয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে দেননি। এখানে এসেও ছেলেকে পেলাম না।’ ছেলে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন আর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তিনি।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) প্রিয়জন ফিরে পেয়ে অনেকের চোখেমুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও অনেকেই প্রিয়জনদের ফিরে না পেয়ে কান্নায় নুনিয়াছড়া জেটিঘাটের আকাশ বাতাস ভারী করেছে। তারাও হারানো স্বজনদের ফিরে পেতে আকুতি জানান সরকারের কাছে।
বুধবার দুপুর ১ টায় গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ মিয়ানমারের জাহাজ থেকে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ‘কর্ণফুলী টাগ-১’ জাহাজে করে শহরের বাঁকখালী নদীর বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে আনা হয়। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ইমিগ্রেশনের জন্য সবাইকে একটি প্যান্ডেলে রাখা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মিয়ানমার কারাগার থেকে ১৭৩ বাংলাদেশি নাগরিক হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ ও কক্সবাজার-৩ এর সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল। এসময় তিনি বলেন, সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমারের কারাগারে বন্দী ১৭৩ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যাঁদের ইতিমধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। আরো সব বাংলাদেশি নাগরিক মিয়ানমার কারাগারে রয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ করবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ মিয়ানমার দূতাবাস সূত্র জানায়, মিয়ানমার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশী ১৭৩ জন নাগরিকদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ১২৯ জন, বান্দরবানের ৩০ জন, রাঙামাটির ৭ জন, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার ১ জন করে আরও সাতজন রয়েছেন।
এদিকে মিয়ানমারের জাহাজে করে আসা দেশটির একটি প্রতিনিধিদল বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে সড়কপথে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে গিয়েছে। সেখানে ১১ বিজিবির হেফাজতে রয়েছে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ২৮৭ জন সেনা ও সীমান্তরক্ষী বিজিপি সদস্য। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সকালে মিয়ানমারের ‘চিন ডুইন’ জাহাজে করে ২৮৭ জন সেনা ও বিজিপি সদস্যকে নিয়ে সিতওয়েতে ফিরে যাবে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল।