টিটিএন বিশেষ অনুসন্ধান (প্রথম পর্ব)
বিশেষ প্রতিনিধি ও শামীমুল ইসলাম ফয়সাল, উখিয়া থেকে
“স্যার’ একটু বের হন না তাড়াতাড়ি, গাড়ি ঢুকছে।” সময়ে অসময়ে এভাবে বার্তা দিয়ে উখিয়া রেঞ্জের বনকর্তাদের বিভ্রান্ত করে কতিপয় ইনফর্মাররা (তথ্যদাতা)।
উখিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এলাকাভিত্তিক সক্রিয় পাহাড়খেকোদের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট, পাহাড় দখল নিয়ে এসব সিন্ডিকেটের মাঝে রয়েছে অর্ন্তকোন্দল।
এই অর্ন্তকোন্দলের জেরে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করে নিজেদের ছত্রছায়ায় থাকা কথিত ইনফর্মারদের, যারা বনবিভাগকে নিজেদের প্রতিপক্ষ কতৃক পাহাড় নিধনের তথ্য দিয়ে থাকে।
শুকনো মৌসুমের প্রায় প্রতিদিন রাতেই পাহাড় ও খাল আবেষ্টিত রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা গ্রামে চলে অবৈধ ভাবে মাটি কাটা কিংবা বালি উত্তোলন।
৩১ মার্চ (রবিবার) রাত দুইটার দিকে দোছড়ি বিটের দায়িত্বরত বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান কে মুঠোফোনে বারবার কল দিয়ে ঐ এলাকায় ডাম্পার (মিনিট্রাক) প্রবেশের তথ্য জানায় স্থানীয় নুরুল আলম মাইজ্জা প্রকাশ ডরমনু’র পুত্র হেলাল উদ্দিন।
সাজ্জাদের সহকর্মী শোভন জামান তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ঐ দিন রাতে উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাপ্তরিক কাজ শেষ করে রাত দেড়টার দিকে বাসায় ফিরেন সাজ্জাদ।
এসময় সাজ্জাদ’কে খবর দেওয়া হয় – ” পাহাড় খেকোরা সেহেরির টাইমের সুযোগ নিয়ে সংরক্ষিত বন থেকে ডাম্পারে করে মাটি পাচারের জন্য কাজ শুরু করেছে। ”
রাতের খাবার ও সেহেরি একসাথে শেষ করে নিজের কর্তব্য পালনে অনড় থাকা সাজ্জাদ সরকারি মোটর সাইকেল যোগে সঙ্গী আলী কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন অভিযানে।
রাত ৩ টা ১৫ এর দিকে হরিণমারা গ্রামের লালুবাপের টেক এলাকায় পৌঁছাতেই সাজ্জাদ অবৈধভাবে মাটি সরবরাহে ব্যবহৃত একটি ডাম্পার কে থামানোর চেষ্টা করেন।
মূহুর্তের মধ্যে ঐ ডাম্পার তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়, ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাজ্জাদ।
এ ঘটনায় উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক আরো ৫/৬ জন কে অজ্ঞাত আসামী করে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় কথিত ইনফর্মার হেলাল কে ৪নং আসামী করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, বিবাদী দের বিরুদ্ধে বন আইনে একাধিক পিআরও মামলা দায়ের করেছিলেন সাজ্জাদ।
স্থানীয় সূত্র বলছে, হেলাল নিজেও পাহাড় নিধনে ব্যবহৃত ডাম্পার পরিচালনা করতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ” এখলাস মিয়ার বাড়ির পাশের পাহাড় থেকে মাটি কাটা শুরু করেছিলো পাহাড়খেকো সিন্ডিকেট এর সদস্য কানা ছৈয়দ আলম। হেলালের সাথে কানার সখ্যতা থাকলেও সে ও তার সিন্ডিকেটের অন্যরা এই কাজে কোন ভাগ পাই নাই। ”
অন্যদিকে, ছৈয়দ আলমের সাথে সম্পৃক্ত আরেক ডাম্পার চালক কামাল উদ্দিন ড্রাইভারের ব্যবহৃত ডাম্পার ঘটনার তিন দিন আগে (শুক্রবার) হরিণমারা থেকে জব্দ করেন সাজ্জাদ।
ঘটনার পর স্থানীয় পর্যায়ের আলোচনা উঠে এসেছে এই কামালের নাম, কারো কারো মতে হত্যাকাণ্ডের সময় ঘাতক ডাম্পারের চালক বাপ্পীর পাশেই বসা ছিলো সে।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম বলেন, “ঘটনার দিন রাত দেড়টা পর্যন্ত সাজ্জাদ ও আমি একসাথে অফিসে কাজ করেছি। আমার রেঞ্জের কর্মঠ সাহসী কর্মকর্তা সাজ্জাদ আর নেই, এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের ।তিনি অত্যন্ত সাহসী ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল ছিলেন।”
তিনি জানান, ” আগে থেকেই ক্ষিপ্ত পাহাড়খেকোরা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।সাজ্জাদের মাথার ওপর ট্রাকের চাকা তুলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।”
ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এজাহার নামীয় এক আসামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, জব্দ করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার ডাম্পার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বলে জানান, উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসাইন।
বুধবার (৩ এপ্রিল) সাজ্জাদুজ্জামান হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার, সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে উখিয়ায় ও সিলেটে মানববন্ধন হয়েছে।
এছাড়াও মঙ্গলবার কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন প্রতিবাদ সমাবেশ।