কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাবলেট— অনেকেরই দিনের একটা বড় সময় কাটানো হয় এসব যন্ত্রের সামনে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারনেট ও মোবাইল পর্যালোচনামূলক ওয়েবসাইট ‘রিভিউস ডটঅর্গ’-এর এক জরিপ অনুযায়ী, একজন আমেরিকান নাগরিক গড়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটান স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে।
এই দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে ঘাড় ও কাঁধে যে অস্বস্তিকর ব্যথা দেখা দেয়, তাকেই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ‘টেক নেক’।
রিয়েলসিম্পল ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সমস্যার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ‘হোয়াগ অর্থোপেডিক ইন্সটিটিউট’য়ের মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞ এবং সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. জেরেমি স্মিথ।
তিনি বলেন, “আমাদের মাথার ওজন গড়ে ১২ থেকে ২০ পাউন্ড। একটা বোলিং বলের মতোই ভারী! দীর্ঘ সময় নিচের দিকে ঝুঁকে থাকার কারণে ঘাড়ের পেশি এমন ভঙ্গি সহ্য করতে না পেরে ব্যথা ও অস্বস্তির মাধ্যমে বার্তা পাঠায়।”
টেক নেক কীভাবে হয়?
নিউ ইয়র্ক শহরের ‘বেসপোক ফিজিক্যাল থেরাপি’র ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট ডা. জেসিকা লেফকোভিটজ ব্যাখ্যা করেন, “টেক নেক’ সাধারণত দেখা যায় যখন কেউ দীর্ঘসময় ধরে কম্পিউটারে কাজ করেন। মাথা সামনে এগিয়ে আসে, কাঁধ ঝুঁকে পড়ে—এই ভঙ্গি ঘাড় ও বুকের পেশিকে শক্ত করে ফেলে এবং সঠিক ভঙ্গি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু কম্পিউটার নয়, মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকা বা সোফায় কুঁজো হয়ে বসাও এই সমস্যা বাড়ায়।”
টেক নেক হয়েছে- বোঝার উপায়
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইয়েল স্কুল অব মেডিসিন’য়ের মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. পিটার জি. হোয়াং বলেন, “কম্পিউটার বা ফোনের সামনে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা, শক্তভাব, এমনকি মাথাব্যথা হলে বুঝতে হবে এটি ‘টেক নেক’ হতে পারে।”
কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা হাতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ডা. লেফকোভিটজ বলেন, “মাথা ঘোরানো বা সামনে পেছনে নাড়ানোতে ব্যথা হলে এটি এক ধরনের লক্ষণ। ঘাড়ের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন নিজের কাজ করার সময় পাশ থেকে ভিডিও তুলে। এতে নিজের ভঙ্গি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হবে।”
তবে যদি বাহুতে ঝাঁ ঝাঁ-ভাব, জ্বালাপোড়া বা অবশতা অনুভূত হয় তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, কারণ এটি স্নায়ু আক্রান্ত হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।
ঘরে বসে ‘টেক নেক’ থেকে মুক্তির উপায়
ডা. হোয়াং-এর মতে, স্ক্রিনের সময় যতটা সম্ভব সীমিত করা উচিত। দীর্ঘসময় স্ক্রিন ব্যবহার করলে সঠিক ভঙ্গিতে বসে চোখের সমান্তরালে স্ক্রিন রাখতে হবে। অনেকেই নিজের ভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। তাই প্রতি ৩০ মিনিট পরপর নিজের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
ডা. লেফকোভিটজ পরামর্শ দেন, “কম্পিউটারে কাজ করার সময় অ্যালার্ম সেট করে বসার ভঙ্গি পরখ করার অভ্যাস করুন। এতে শরীর সচেতন থাকবে এবং সময়মতো ব্যায়াম করার সুযোগ তৈরি হবে।”
তিনি ঘাড়ের নমণীয়তা বাড়াতে কয়েকটি সহজ ব্যায়ামের কথা বলেন—
সোজা হয়ে বসে মাথা সামনে ও পেছনে ১০ বার নাড়ানো।
মাথা ডানে-বাঁয়ে ঘোরানো ১০ বার।
কান ঘাড়ে ছোঁয়ানোর চেষ্টা করা, উভয় পাশে ১০ বার।
মোবাইলে স্ক্রল করার সময় ডা. স্মিথের পরামর্শ, “পেটের দিকে তাকানোর বদলে মোবাইল চোখের সমান্তরালে ধরুন, এতে ঘাড় আরাম পাবে।”
যেসব ব্যায়াম ‘টেক নেক’ কমাতে সহায়ক
ডা. লেফকোভিটজ ‘টেক নেক’এর ব্যথা কমাতে কিছু ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সার্ভিক্যাল ফ্লেক্সন/এক্সটেনশন
সোজা হয়ে বসে চিবুক বুকে লাগানোর চেষ্টা করুন। এরপর মাথা যতদূর সম্ভব পেছনে ঝুকিয়ে দিন। এই ব্যায়াম দিনে তিন থেকে পাঁচবার, প্রতি বার ১০বার করে করুন।
সার্ভিক্যাল রোটেইশন
সোজা হয়ে বসে মাথা ডান ও বাম দিকে ঘুরান, যেমন- কাউকে পেছনে ফিরে দেখছেন। প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচবার, প্রতি বার ১০বার করে করুন।
সার্ভিক্যাল সাইড বেন্ড
সোজা হয়ে বসে মাথা এক পাশে কাত করুন, যেন কানটি ঘাড়ে ছোঁয়ায়। উভয় পাশে ১০বার করে করুন, দিনে তিন থেকে পাঁচবার।
দরজার ফ্রেমে বুক প্রসারণ ব্যায়াম
দরজার ফ্রেমে দুই হাত গোলপোস্টের ভঙ্গিতে রেখে সামনে এগিয়ে যান। এতে বুকের পেশি প্রসারিত হবে। এই স্ট্রেচ তিনবার করুন, প্রতি বার ৩০সেকেন্ড ধরে রাখুন।
প্রোন স্যুইমারস
পেটের ওপর শুয়ে পড়ুন, কপাল মেঝেতে রাখুন (প্রয়োজনে তোয়ালে ব্যবহার করতে পারেন)। হাত পেছনে কোমরের নিচে রাখুন, যেন হাতকড়া পরা অবস্থায় আছেন। এরপর সেই হাত ওপরে উঠিয়ে এমনভাবে বাড়ান, যেন আপনি পুলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর