চায়ের দোকানে চার বন্ধু। চলছে জমাটি আড্ডা, তবে ‘শ্রুত’ হওয়ার মতো শব্দ নেই কোনো। চোখের ঝিলিকে, নীরব হাসিতে, মুখের অভিব্যক্তিতে বুঝে যান তাঁরা একে অপরের কথা।
ঝিনাইদহের রিপন মিয়া, তরিকুল ইসলাম, হাশেম আলী আর রাজু আহম্মেদ—এই চারজনের কণ্ঠে আওয়াজ নেই, বাক্প্রতিবন্ধী। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁদের ভেতরে যে ভাষা আছে, সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই তাতে দখল নেই! তাঁরা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝেন ‘মন খারাপ’, হাতের নড়াচড়ায় বুঝে নেন ‘দেরি কেন হলো’, ঠোঁট উল্টিয়ে বুঝিয়ে দেন ‘চায়ে মিষ্টি বেশি’। এ যেন অন্যতর এক কাব্য, যা কালিতে নয়, লেখা হয় অনুভবে। এই অনুভবের আরেক নামই তো ‘বন্ধুত্ব’।
বন্ধু মানে সেই মানুষ, যার সঙ্গে ভাববিনিময়, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য ‘শব্দ’ জরুরি নয়। বন্ধুত্বে ‘ভালো আছিস’ বলারও দরকার পড়ে না, পাশে দাঁড়ানোই যথেষ্ট। একবার চোখের দিকে তাকিয়ে একদম বোঝা যায়—সব ঠিক আছে, নাকি ভেতরে কিছু ভাঙছে! বন্ধু পাশে থাকলে বৈরী সময় সহজ হয়ে আসে, ভালো সময় হয়ে ওঠে আরও রঙিন।
বন্ধুত্বের ভাষা তাই সর্বজনীন। একে অপরের বন্ধু হতে লাগে না কোনো ‘যোগ্যতা’, হতে হয় না এক ভূখণ্ডের অধিবাসী হওয়ার কিংবা একই বর্ণের বা মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার। শ্রেণিভেদের ধারণা যেখানে বিলীন হতে থাকে, বৈষম্যের দেয়াল যেখানে ভেঙে পড়ে, সেখান থেকেই বন্ধুত্বের শুরু।
বন্ধু দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য সেই কথাটিই এলান করছে: ‘বিল্ডিং ব্রিজেস: সেলিব্রিটিং ডাইভারসিটি, সলিডারিটি অ্যান্ড আ কালচার অব পিচ’। অর্থাৎ বন্ধুত্ব সেই শক্তিশালী সেতুবন্ধ, যা সমাজ-সংস্কৃতির পার্থক্য পেরিয়ে ঐক্য, বোঝাপড়া ও শান্তি স্থাপন করে।
মানুষ বন্ধুত্ব উদ্যাপন করছে বহু শতাব্দী ধরেই। তবে দিবস পালন বা উদ্যাপনের চল ছিল না এই এক শতাব্দী আগেও। গত ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্ড ও উপহারসামগ্রী তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান হলমার্কের প্রতিষ্ঠাতা জয়েস ক্লাইড হল ২ আগস্ট বন্ধু দিবস উদ্যাপনের বিষয়টি জনসমক্ষে আনেন। পরে র্যামন আর্তেমিও ব্রাচো নামের প্যারাগুয়ের এক চিকিৎসক ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস উদ্যাপনের প্রস্তাব দেন। শেষতক ২০১১ সালে জাতিসংঘ ৩০ জুলাইকে ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ঘোষণা করে।
বন্ধু মানে সেই মানুষ, যার সঙ্গে ভাববিনিময়, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য ‘শব্দ’ জরুরি নয়। বন্ধুত্বে ‘ভালো আছিস’ বলারও দরকার পড়ে না, পাশে দাঁড়ানোই যথেষ্ট। একবার চোখের দিকে তাকিয়ে একদম বোঝা যায়—সব ঠিক আছে, নাকি ভেতরে কিছু ভাঙছে!
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস উদ্যাপন করা হয়। এদিন ফেসবুকের দেয়াল ভরে ওঠে অনুভবের প্রকাশে, স্মৃতির ছবিতে, পাশে থাকার অঙ্গীকারে। কেউ কেউ বন্ধুদের উদ্দেশে চিঠি লেখেন, কেউ বার্তা পাঠান—‘তোকে মনে পড়ে’। কেউ কেউ ঘুরে আসেন সেই পুরোনো আড্ডার ঠেক, যেখানে কেটেছে কত শত বিকেল, সন্ধ্যা, তার ইয়ত্তা নেই। চায়ের দোকান, নদীর পাড়, খেলার মাঠ, কোনো পার্কের বেঞ্চ কিংবা ক্যাম্পাসের সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান বা চত্বর-স্মৃতিজাগানিয়া, বন্ধুত্বের শিকড় ছড়ানো।
নারী উদ্যোক্তা হাসিনা আক্তারের ব্যস্ত দিন কাটে। ‘দেশজ-দেশীয় ঐতিহ্য’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালান তিনি। ফরমায়েশের ভিত্তিতে যেকোনো খাবার বা রান্নার উপযোগী মাছ-মাংস (রেডি টু কুক) সরবরাহ করেন। মাসুমা জাহান গৃহিণী হলেও ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়াসহ সংসারের অন্যান্য কাজে দম ফেলার ফুরসত থাকে না। আর বেসরকারি চাকরিজীবী তাজমুন নাহারের দিন ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা।
তাই বলে বন্ধুত্ব কি চিরটা কাল একই রকম থাকে? না। কেউ দূর চলে যায়, কেউবা হারিয়ে যায় অজানায়, এমনকি কেউ ভুলেও যায়। তবু কিছু থেকে যায় বুকের পাঁজরের ভাঁজে, সুখে মনে পড়ে, দুঃখেও মনে পড়ে—একসময় ‘আমরা’ ছিলাম এখানে।
তবু এই তিন বন্ধু মাঝেমধ্যে সময় বের করে একসঙ্গে সময় কাটান। গত শুক্রবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি রেস্তোরাঁয় কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। বন্ধু দিবসে সময় হবে না, তাই আগাম দিনটিকে উদ্যাপন করতে এক হয়েছিলেন তাঁরা।
হাসিনা আক্তার বললেন, সংসার, কাজের চাপ তো থাকবেই। তাই বলে প্রিয়জন কেন হারিয়ে যাবে? একটু যত্নশীল হলে বন্ধুত্বসহ যেকোনো সম্পর্ক অটুট থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্ধুত্বের মানে সবার কাছে হয়তো এক রকম নয়, কিন্তু বন্ধুত্ব যে সব সম্পর্ক থেকে আলাদা, সেটা সবাই মানবেন। এ কারণে বিশেষ এ সম্পর্ককে বিশেষভাবে মূল্যায়নের জন্য একটি দিনের দরকার আছে বৈকি।
এ কথায় সহমত পোষণ করে মাসুমা জাহান বললেন, ‘বন্ধুত্ব আসলে ৩৬৫ দিনেরই, সেই কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা দিবস উদ্যাপন, এটা মন্দ নয়। তবে আপনি-আমি যে কেউ তো আসলে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো বৃহত্তর মানবসমাজের অংশ, তাই দেশ ভালো না থাকলে আপনি ভালো থাকবেন না, বিশ্বের কোথাও অশান্তি থাকলে তা আপনকেও পীড়িত করবে।’
ঝিনাইদহের চার বন্ধু আমাদের শেখায়, বন্ধুত্বের জন্য ভাষার প্রয়োজন পড়ে না। আর ঢাকার তিন বন্ধু বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতে, তথা ঐক্য ও শান্তি স্থাপনের জন্য আওয়াজ ওঠানোর বিকল্প নেই।
মাসুমা জাহানের এ কথার রেশ ধরে তাজমুন নাহার বললেন, ‘ফিলিস্তিনের গাজাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে হানাহানি, সংঘাত চলছে। না খেতে পেরে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে পারে আমাদের অপরের প্রতি সহমর্মিতা, আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন মানসিকতা। এ জন্য বন্ধু দিবস হতে পারে বড় উপলক্ষ।’ তাজমুন নাহারের মতে, বন্ধু দিবস হতে পারে সব বৈরিতা অবসানের দিন।
ঝিনাইদহের চার বন্ধু আমাদের শেখায়, বন্ধুত্বের জন্য ভাষার প্রয়োজন পড়ে না। আর ঢাকার তিন বন্ধু বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতে, তথা ঐক্য ও শান্তি স্থাপনের জন্য আওয়াজ ওঠানোর বিকল্প নেই।
সবাইকে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।
সূত্র: প্রথম আলো