আড়াই বছর পর ফের কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীর এলাকায় গড়ে উঠা স্থাপনার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে।
নদীর তীরবর্তী কক্সবাজার শহরের প্রাণ কেন্দ্র কস্তুরাঘাট এলাকায় সোমবার সকাল থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় কক্সবাজার প্রশাসন যৌথভাবে এই অভিযান শুরু করে।
এর আগে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ দুইদিনের অভিযানে নদীর তীর থেকে ৬ শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল জেলা প্রশাসন। কিন্তু আড়াই বছরে মাথায় ফের তা দখল করে তৈরি হয়েছে হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ- বিআইডব্লিউটিএ বলছে, আদালত এই এলাকায় স্থিতাবস্থার নির্দেশনা দিলেও তা না মেনে এখানে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি সংস্থাটির বন্দর বিভাগের পরিচালক একে এম আরিফ উদ্দিন জানান, নদীর নাব্যতা হারানোর জন্য বেসরকারি প্রভাবের পাশাপাশি সরকারি প্রভাবও রয়েছে। যেমন নদী শাসন করে ছোটো করা হয়েছে ব্রীজ করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে উৎপত্তি হয়ে ৮১ কিলোমিটারের বাঁকখালী নদীটি রামু ও কক্সবাজার সদর হয়ে শহরের কস্তুরাঘাট-নুনিয়াছড়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই ছয় কিলোমিটারে ১ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস এবং বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের পৃথক তালিকা তৈরি করেছে ।
একে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, আমরা ১৯৯৬ সালেও দেখেছি এখানে (কস্তুরাঘাট) নদী ছিল। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ আসতো এখানে। কুতুবদিয়া-মহেশখালী থেকে ফিশিং ট্রলারগুলো আসতো। যখন সাগর উত্তাল থাকতো, নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় হতো তখন ফিশিং ট্রলারগুলো এই নদীতে এসে আশ্রয় নিতো। দখলদারদের কারণে বাঁকখালীর এই অংশটুকু বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিআইডব্লিউটিএকে বাঁকখালী নদীবন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে নদী তীরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। জমি বুঝিয়ে দিতে বারবার জেলা প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা তা দেয়নি। ফলে নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় দখল অব্যাহত ছিল।
বিআইডব্লিউটিএ-এর বন্দর বিভাগের পরিচালক বলেন, কিছু দখলদারদের চাপের মুখে পড়ে এই নদীকে দখলমুক্ত করা যায়নি। পরে মামলাও হয়েছিল। এরপর বেলার পক্ষে রায় দিয়েছিল আদালত। সেই রায়ের মধ্যে একটি ছিল অবৈধ দখলদারদের অপসারণ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়টি ছিল বাঁকখালী নদীকে বাঁচাতে এটিকে ইকোলজিকাল ক্রিটিকাল এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
“সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নৌ উপদেষ্টা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন উচ্ছেদ অভিযান করার। প্রাথমিকভাবে আমরা ৫ দিনের একটি অভিযান পরিচালনা করবো যেটি আজকে থেকে শুরু হলো।”
এদিকে প্রথমদিনে প্রায় ৫ একর পরিমাণ জায়গা দখল্মুক্ত করে শতাধিক পাকা, আধাপাকা, কাঁচা স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের মূল টার্গেট এখানের স্থাপনা উচ্ছেদ করা না, নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া। এরপর নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
বিআইডব্লিউটিএ কাজ করে নদী রক্ষক হিসেবে জানিয়ে সংস্থাটির পরিচালক আরিফ উদ্দিন বলেন, বাঁকখালী নদীকে ঘিরে অন্যান্য কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। পাশাপাশি নদী রক্ষা কমিশন আছে তারা বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
কক্সবাজারকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার অগ্রগতি বর্ণনা করে তিনি করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ৬ নং ঘাটে স্লাব তৈরি করেছি, পল্টুন স্থাপন করেছি, সী-ট্রাক চাকু করেছি। নুনিয়ারছড়া ঘাটে পল্টুন স্থাপন করেছি, মহেশখালী ঘাটে পল্টুন স্থাপন করেছি। পাশাপাশি আমাদের পরিকল্পনা আছে শুঁটকি পল্লীতে ড্রেজার বেইস স্থাপন করার। আমরা আশা করছি শীঘ্রই এটি নদীবন্দর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে।
এদিকে বাঁকখালী নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামি চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ আগস্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। ওই নির্দেশনার সূত্র ধরে গত শনিবার কক্সবাজার সফরে আসেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে ‘উচ্চ আদালতের আদেশ মোতাবেক বাঁকখালী নদী দুষণ ও দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে বিশেষ সমন্বয় সভা করেন।
তবে উচ্ছেদের মুখে থাকা কস্তুরাঘাটের উকিল পাড়ার বাসিন্দারা নানান অভিযোগ তুলেছেন প্রশাসনের দিকে। নতুন ব্রীজ হওয়ার পর অনেকটা ব্রীজের নিচেই এই পাড়াটি গড়ে উঠে ৫ বছরের ব্যবধানে। বেশিরভাগ আইনজীবীরা এখানে জায়গা কিনেছেন বলে নাম হয়েছে উকিল পাড়া।
সেখানকার বাসিন্দা সীমা রাণী দাশ বলেন, এগুলো তো উচ্ছেদ না। উচ্ছেদের নামে আমাদেরকে গলা টিপে পিষে ওরা মেরে ফেলতে চাচ্ছে। জায়গাটা যদি নদী থাকে তাহলে সরকার আমাদের কাছ থেকে প্রতি বছর খাজনা নিয়েছে কেন? আমাদেরকে উচ্ছেদ করতে হলে সরকার ওখানে থাকার অনুমতি দিয়েছিল কেন? যদি সরকার অনুমতি না দিত তাহলে তো আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে জায়গাটা কিনতাম না।
এধরণের অভিযোগের বিষয়ে ও কোন প্রক্রিয়ায় তাদের কাছ থেকে খাজনা নেয়া হলো জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, সেটা কাগজ দেখে বলতে হবে।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, এখানে অনেকে দখল করে নকল কাগজ বানিয়েছেন। সেই কাগজ আবার অনেকে বিক্রি করেছেন। এতে ভূমি অফিসসহ সরকারি অনেক দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও জড়িত।