রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবার শিশুদের ব্যবহার করে শিশু অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। আমাদের হাতে আসা একটি ভিডিওতে এমন এক শিশু অন্য এক শিশুকে অপহরণে সহযোগিতা করার দায় স্বীকার করতে দেখা গেছে।
রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলা ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, সহযোগিতাকারী শিশু বলছে, “আব্দুর শুক্কুর নামের এক লোক আমাকে ডেকে বলে একটা ছোটো ছেলেকে যদি এনে দিতে পারি ৫শ টাকা দেবে। শার্ট কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারলে আরো ৫০ টাকা দেবে।”
ওই ভিডিওতে শিশুটি নিজের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের কয়েকটি ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গাদের সামাজিক নেতা) ও সংগঠনের কর্মীদের সাথে কথা বলে এধরণের ভিডিওর সত্যতা পাওয়া গেলেও ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন -এপিবিএন বলছে এধরণের কোনো অভিযোগ বা ভিডিও তাদের নজরে আসেনি।
আশ্রয় শিবিরের ৩নং ক্যাম্পের মাঝি মো. ছিদ্দিক জানান, ক্যাম্পে শিশু দিয়ে শিশু অপহরণের ঘটনা নতুন করে ঘটছে। বড়দের ধরলে অনেক সময় মুক্তিপণ ঠিকঠাক পাওয়া যায়না, তাই এখন শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এভাবেই নতুন ফাঁদ পেতে।
১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ সিরাজ আমীন বিডিনিউজকে জানান, রোহিঙ্গারা বেশিরভাগ সময়ই কিছু ভিডিও নিজেরা তৈরি করে, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে নিজেদের নজরকাড়ার জন্য।
আরো বেশ কয়েকটি ভিডিও আমাদের হাতে এসেছে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে – শিশুদের অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে, কোথাও গলা চেপে ধরা হচ্ছে, কোথাও মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে গলা থেকে পা অবধি।
এমন একজন ভুক্তভোগী হলেন আব্দু রহমান। যিনি ১৯ নং ক্যাম্পের সি-১৫ ব্লকের বাসিন্দা। তার ৬ বছরের শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় ৮ জানুয়ারি দুপুরে খেলার মাঠ থেকে। পরে মাটিতে পুঁতে রেখে ভিডিও পাঠানো হয় তার কাছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় সাত লাখ টাকা।
আব্দু রহমান জানান, প্রথমে ৫০ হাজার টাকা পাঠান তিনি। ছেলেকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে হয়রানি করা হয়, সর্বশেষ ২ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সন্তানকে ফেরত পান।
এবিষয়ে এপিবিএন কর্মকর্তা সিরাজ আমীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়েন, রোহিঙ্গাদের আর্থ সামাজিক অবস্থায় এতো টাকা দেয়া কিভাবে সম্ভব!
তিনি বলেন, এধরণের অপহরণ হলে রোহিঙ্গারা আমাদের কাছে খুব আসেননা। তারা অনেক সময় নিজেরাই এসব স্যাটেল করে নেন। পুলিশের কাছে না এসে তারা যায় ইউএনএইচসিআর কাছে, নাহয় ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।
তবে ভুক্তভোগী আব্দু রহমান জানান, তিনি ১২ জানুয়ারি ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে সন্তানকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করেছিলেন। পরে সেটি উখিয়া থানা পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু তেমন সাড়া পাননি তিনি। এমনকি উদ্ধারের পরেও পুলিশকে অবহিত করেছিলেন।
এ সংক্রান্ত আবেদনের দুটি কপি আব্দু রহমান আমাদের কাছে প্রেরণ করেন।
আব্দু রহমান বলেন, আমি আমার আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ টাকা ধার নিয়েছি। বাকিটাকা মসজিদের মাধ্যমে চাঁদা তুলেছি।
আশ্রয় শিবিরের ১২ নং ক্যাম্পের মাঝি এনায়েত উল্লাহ জানান, ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যেতে চায়না কারন অনেক জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। আর তেমন একটা সমাধান না পাওয়ায় যেতে চায়না।
এনায়েত উল্লাহ বলেন, বেশিরভাগ ঘটনা জোয়া ও মাদক কেন্দ্রীক হওয়ায় সত্যিকার অর্থে অপহরণ হওয়া ঘটনা গুলোকেও পুলিশ অনেক সময় পাত্তা দিতে চায়না।
ক্যাম্পের সামগ্রিক অপহরণ বিষয়ে জানতে চাইলে এপিবিএনের অতিরিক্ত ডিআইজি সিরাজ আমীন জানান, বিভিন্ন কারনে এখানে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু অপহরণ না।
“যেমন, রোহিঙ্গাদের অনেকে অনলাইন জোয়ায় আসক্ত। এতে হেরে গেলে টাকা দিতে না পারলে আটকে রাখে। তখন পরিবারের কাছে ফোন করে বলে টাকা দিতে। কিন্তু কিসের জন্য আটকে রাখা হয়েছে সেটি বলেনা।”
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে মাদক ব্যবসা করতে গিয়ে পাওনা টাকা কেন্দ্রীক ঘটনাকেও তারা অপহরণ হিসেবে চালিয়ে দেয়।”
সিরাজ আমীন বলেন, “তবে কিছু অপহরণের রিয়েক কেউস যে ঘটেনা, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের লোকজন ফাঁকা পেয়ে কয়েকজনকে নিয়ে যায়। কিন্তু এ সংখ্যাটা খুবই কম।”
“তবে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে অনেক অপরাধ দমন করা সম্ভব করা সম্ভব হয়ে উঠেনা।”
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা জানান, অপহরণের ঘটনা গুলো নিয়ে আমরাও অবগত। বিষয়টি নিয়ে এপিবিএনের উচ্চ পর্যায়ের সাথে আমাদের কথা হচ্ছে। ক্যাম্পের অনেক অপরাধ এখন কমে এসেছে, উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে অপহরণের বিষয়েও।
জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, টেকনাফে বিগত ২০২৪ সালে এক বছরে ৬২ টি অপহরণ মামলা রেকর্ড হয়েছে। পুলিশের উদ্ধার তালিকায় আছে ১৩৮ জন ভুক্তভোগী।
আর ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৫৩ জন অপহরণের শিকার হন। যার মধ্যে ৯৪জন স্থানীয় বাসিন্দা ও ৫৯ জন রোহিঙ্গা। এসব পরিবারের দাবী অনেকেই ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে। ।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনার পর অভিযোগ আসুক বা না আসুক পুলিশ তৎপর হয়েছে এবং অপহরণের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন অপরাধীও ধরা পড়েছে। আর যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে তাদের ধরতে তৎপরতা অব্যাহত আছে।