কক্সবাজারের খুরুস্কুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ন প্রকল্পে পুনর্বাসনের প্রকৃত তালিকা করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টার দিকে কক্সবাজার পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতি পাড়ায় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিলুফার ইয়াসমিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এ তালিকা করতে যায় প্রশাসনের একটি দল। কিন্তু বাধার মুখে তালিকা না করেই ফিরে আসে দলটি।
প্রায় দুই ঘন্টার বেশি সময় ইউএনও নিলুফার ইয়াসমীন বুঝানোর চেষ্টা করেন স্থানীয়দের। কিন্তু স্থানীয়দের দাবী পুনর্বাসন নয়, তারা এখন যেখানে আছেন সেখানেই স্থায়ী বন্দোবস্তো চাইছেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা ৪ হাজার ৪০৯ জন উপকারভোগীর তালিকা ‘ত্রুটিপূর্ণ, প্রশ্নবিদ্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট’ বিবেচনায় বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে রয়েছে ইতোমধ্যে প্রকল্পে ফ্ল্যাট বুঝে পাওয়া ৬০০ পরিবারও। গত ১৪ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এর প্রেক্ষিতেই এবার সরকারের নির্দেশনা পেয়ে প্রকৃত তালিকা করার জন্য যায় জেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা বলছেন, তাদের উচ্ছেদ করার জন্য তালিকাটি করা হচ্ছে তাই এলাকার বাসিন্দারা বাধা দিচ্ছেন। সকাল থেকে সমিতি পাড়ার বাসিন্দারা রাস্তায় বিক্ষোভ করে এর প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
এসময় ইউএনও নিলুফার ইয়াসমিন চৌধুরীর বলেন, একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, এখানে উচ্ছেদ শব্দটা প্রয়োগই হচ্ছে না, উচ্ছেদের কোন বিষয় নাই।সরকার বলেছে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তালিকা প্রণয়ন করতে। আশ্রয়ন প্রকল্পে যে ফ্ল্যাটগুলি তৈরি হয়েছে সেগুলোতে যদি মানুষ না যায় তাহলে ফ্ল্যাটগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকারের সম্পদ নষ্ট হবে। অথচ এখানে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ফ্ল্যাটগুলোতে যেতে আগ্রহী। আমরা সেই আগ্রহী মানুষদের খুঁজছি এবং তাদের বসবাসের জন্য তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা কাউকে জোর করিনি।
ইউএনও বলেন, এখানে এমন অনেক মানুষ আছে যারা জেলা প্রশাসনে অনেকবার দরখাস্ত করেছে। তারা নিজেরা স্ব ইচ্ছায় পুনর্বাসনের কথা বলেছে, নিরাপদ বাসস্থানের জায়গা খুঁজেছে। অনেকে বলেছে এখানে জোয়ার ভাটার পানি আসে। তাদের লবণ পানি পান করতে হয়। সব পরিস্থিতি বর্ণনা করে তারা আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসের দাবি জানিয়েছেন অনেকবার।
বিক্ষোভে আসা স্থানীয় সিরাজুল হক বলেন, আমরা এখানে যেমন আছি অনেক ভালো আছি। আমরা আমাদের ভিটেমাটি ছাড়তে চাই না। যদি আমাদের ভিটা ছাড়তে হয় তাহলে আমাদের জীবন নিয়ে নিতে হবে। আমরা তো কোন ফ্ল্যাট চাইনি, আশ্রয়ন প্রকল্পে আশ্রয় চাইনি তাহলে কেন তারা আমাদের তালিকা করতে এসেছে। আমরা কোন উন্নত বাসস্থান চাই না, আমরা শুধু আমাদের জায়গা চাই যেখানে আমরা যুগ যুগ ধরে বসবাস করছি।
স্থানীয় মুসলিম উদ্দিন বলেন, দরকার পড়লে মরে যাব তবুও আমাদের জায়গা ছাড়বো না। রক্ত দিয়ে হলেও আমরা আমাদের ভিটা রক্ষা করব। আমাদের জন্ম হয়েছে যেখানে আমরা সেখানেই মরবো। আমাদের কোন ফ্ল্যাট লাগবে না।
ষাটোর্ধ মো. বেলাল বলেন, আমরা এই জায়গায় বসবাস করছি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে। আমাদের জায়গা কিভাবে কেড়ে নেয় আমরা দেখে নেব।আমাদের ভিটে মাটি কেড়ে নিতে দেবো না। আমরা বন্যাবাসী। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে আমরা বসবাস করছি। তবুও আমাদের কোন আক্ষেপ নেই। আমরা সমিতি পাড়াবাসী সবাই একজোট হয়েছি। আমাদের ভিটেমাটি আমরা রক্ষা করেই ছাড়বো।
উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা দিদারুল ইসলাম রুবেল বলেন, আমরা অবৈধভাবে উচ্ছেদ হতে চাইনা। কারণ এটি আমাদের ৪২ বছরের বাসস্থান। এখানে আমাদের বাবা মার পেশা। বাচ্চাদের স্কুলও এখানে। এটি শুধু আমাদের বাসস্থান নয় আমাদের জীবিকারও জায়গা। তাই এই জায়গা ছেড়ে যেতে হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।
দিদারুল ইসলাম বলেন, এর আগে আশ্রয়ন প্রকল্পে যাদেরকে বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন অনাহারে দিনযাপন করছেন। তাদের বাচ্চারা টোকাই হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় ছিনতাই করছে। এসব কেন করছে তারা? পেটের জন্যই তো। তাই আমাদেরকেও যদি আশ্রয়ন প্রকল্পে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আমাদের বাচ্চারাও ছিনতাই শুরু করবে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
রুবেল বলেন, ফ্ল্যাটের তালিকা বাতিল হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছি। আমাদের ওই আয়না ঘরের মতো ফ্ল্যাট নয়, দরকার স্থায়ী বাসস্থান।
তবে জেলা প্রশাসক মো. সালাউদ্দিন বলেছেন ওই এলাকার বাসিন্দাদের হয়ে কিছু প্রতিনিধি তার কাছে গিয়েছিলেন পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে। তারা তালিকা প্রণয়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন জেলা প্রশাসনের কাছে।
জেলা প্রশাসক মো. সালাউদ্দিন বলেন, এ বছরের শুরুর দিকে ওই এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছিলেন এবং সরকারের কাছে এর আগের তালিকাটি বাতিল করে নতুন করে তালিকা করার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন আগের তালিকাটি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। সরকার এসব দিক বিবেচনা করে স্থানীয় জনগণের আলোচনা ও চাহিদার প্রেক্ষিতে সেই তালিকাটি বাতিল করেছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, এরপরে প্রশ্ন উঠেছিল কিভাবে পক্ষপাত ছাড়া একটি তালিকা প্রণয়ন করা যায়। যাতে উপযুক্তরা সেই প্রকল্পে স্থান পায়। তারপর সেখানে স্থানীয় জনগণের একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছি। এরপর এলাকাবাসীকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটি গঠনের পর অনেকবার তাদের সাথে আলোচনা করেছি। এরপর এই প্রথমবার তালিকাটি যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা আগানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি সেই এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব যেন বজায় থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখছি।
তিনি বলেন, এখানে উচ্ছেদের কথাটি কোত্থেকে এসেছে সেটি আমার বোধগম্য নয়। তবে কেউ যদি অসাধু কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই উচ্ছেদ শব্দটি আলোচনায় এনে থাকেন তাহলে তাদেরকে চিহ্নিত করাটা খুব জরুরী। কারণ স্থানীয় যারা সেখানে বসবাস করছেন তারা কিন্তু অনেক কষ্টে দিনযাপন করছেন, অর্থনৈতিক ভাবেও তারা কষ্টে আছেন। তাই আমরা তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
আফজারা রিয়া : 






















