২২ জুলাই (মঙ্গলবার) রাত ১০টা ২৫ মিনিট, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় একটি বন্য হাতি।
শংকা ছিলো কক্সবাজারগামী আন্তঃনগর সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রায় ৫০০ যাত্রী নিয়েও।
ট্রেনটির চালক আবদুল আউয়াল সর্বপ্রথম রেললাইনের ওপর হাতিটি দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গতি কমিয়ে নেন। প্রথমে রেললাইন থেকে সরে গেলেও হঠাৎ সেই হাতি শেষ বগিতে ধাক্কা দেয়। এসময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনাস্থল চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী বাহার উদ্দিন বলেন, ‘হাতিটি ব্যারিয়ারবিহীন এলাকা দিয়ে প্রবেশ করেছিল। পরে রেললাইনের পাশের আন্ডারপাস ভেঙে পূর্ব দিকে চলে যায়।’
সাম্প্রতিক এই ঘটনায় সাময়িকভাবে প্রাণহানি না ঘটালেও এটা স্পষ্ট যে, বন্য হাতি ও মানুষ উভয়ের জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ হয়ে উঠছে ক্রমবর্ধমান হুমকি।
আর সেই হুমকির মূলে রয়েছে হাতির করিডোর ধ্বংস ও বনাঞ্চলের দখল। তবে, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বিচরণ করা হাতিদের চকরিয়ার মাতামুহুরী নদী পাড়ি দেওয়ার অভ্যাস নেই।
তাদের জন্য রেললাইন এক ভয়ার্ত সংকট হলেও কক্সবাজারের বাকিসব বনাঞ্চলের চিত্র ভিন্ন। কক্সবাজারের বনাঞ্চলে বন্য হাতিদের চলাচলের ৮টি প্রাকৃতিক করিডোরের প্রায় সব কটিই বর্তমানে সংকুচিত বা বন্ধ হয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প, পর্যটন অবকাঠামো, সড়ক ও রেল প্রকল্প এবং অবৈধ বসতির কারণে হাতির দল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নিজস্ব আবাস ও খাদ্য-পানির সন্ধানে। এর ফলেই বাড়ছে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব, ঘটছে প্রাণহানি।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, গত ২০ বছরে কক্সবাজারে কমপক্ষে ৭০টি হাতি ও অন্তত ৮০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এসব সংঘর্ষে।
- ২০০ হাতির টিকে থাকার লড়াই
বাংলাদেশে বন্য এশিয়ান হাতির মোট সংখ্যা এখন আনুমানিক ২৬৮টি। এর প্রায় ৮০ শতাংশই কক্সবাজারের বনাঞ্চলে বসবাস করে। ২০০১ সালে যেখানে কক্সবাজারে হাতির সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭০। ২০২৪ সালের সরকারি হিসাবে তা নেমে এসেছে ২০০ থেকে ২২০টির মধ্যে। প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৫টি হাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, গুলিবিদ্ধ বা চোরাশিকারের কবলে পড়ে মারা যাচ্ছে।
- রেলপথে বাড়ছে হাতির মৃত্যুঝুঁকি
২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবরও চুনতিতে ঈদ স্পেশাল ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতি আহত হয়ে পরে মারা যায়। গতকালের ঘটনার মতো প্রতিটি রাত্রিকালীন ট্রেন এখন হাতির জন্য বিপজ্জনক—করিডোরের ভেতর দিয়ে রেললাইন যাওয়ার কারণেই।
- করিডোর আছে, পথ নেই
উখিয়া, টেকনাফ, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া ও পেকুয়া- এই উপজেলাগুলোর পাহাড় ও বনাঞ্চলে একসময় ৮টি প্রাকৃতিক করিডোরে নিয়মিত চলাচল করত হাতির দল।
এর মধ্যে ঈদগড়-বাইশারী, ইনানী-টেকনাফ ও খুটাখালী-মেধাকচ্ছপিয়া ছিল সবচেয়ে সক্রিয়।
কিন্তু এখন এসব করিডোরের মাঝখানে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবির, সড়ক ও পর্যটন প্রকল্প।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাতিরা বাধ্য হচ্ছে লোকালয়ে ঢুকে পড়তে। এতে তারা ফসল নষ্ট করছে, ঘরবাড়ি ভাঙছে, মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
- মানুষ হাতি সংঘর্ষে ১৫ বছরে ১৫০ মৃত্যু
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারে হাতির আক্রমণে নিহত হয়েছেন অন্তত ৮০ জন মানুষ।
অন্যদিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ৭০টির বেশি হাতি। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্তই কক্সবাজারে ৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুটি গুলিবিদ্ধ ছিল। অধিকাংশ ঘটনাতেই অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা যায়নি বা বিচার হয়নি।
- সীমান্ত পেরিয়ে আসছে পরিযায়ী হাতি
রাখাইন রাজ্যে বন উজাড়, সংঘাত ও খাদ্য সংকটের কারণে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে নিয়মিত প্রবেশ করছে পরিযায়ী বন্য হাতির দল।
বন বিভাগ বলছে, বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪৫টি হাতি ঘুমধুম, হ্নীলা ও পালংখালী সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক সপ্তাহ থেকে আবার ফিরে যায়। এই চলাচলের পথগুলোতেও কাঁটাতারের বেড়া, বিজিবি পোস্ট ও ক্যাম্প বসায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের যাতায়াত। ২০১৭ সাল থেকে এসব সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আরও ৭ জন।
- রোহিঙ্গা ক্যাম্প: সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আগমনের পর প্রায় ৬ হাজার একর বনভূমিতে গড়ে ওঠে বিশাল আশ্রয়শিবির। এর মধ্যে পালংখালী, বালুখালী ও কুতুপালং হাতির মূল চলাচলের করিডোরে পড়েছে। জাতিসংঘের সহায়তায় গঠিত হয় ৬০টি ‘ইলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’। তারপরও রোধ করা যায়নি সংঘর্ষ।
- প্রজনন আশার আলো, কিন্তু পরিবেশ অনুকূল নয়
বন বিভাগ বলছে, গত পাঁচ বছরে কক্সবাজারে কমপক্ষে ২৫টি হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক বার্তা হলেও শিশুহাতির মৃত্যুহারও বাড়ছে। এর পেছনে বন সংকোচন, খাবারের অভাব এবং প্লাস্টিক দূষণকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অভ্যন্তরীণ উদাসীনতা
আইইউসিএনসহ জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা ২০২২ সালে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী করিডোরগুলোর গুরুত্ব স্বীকার করে ট্রান্সবাউন্ডারি ব্যবস্থাপনার সুপারিশ দেয়। কিন্তু এখনও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হাতি সংরক্ষণে কোনো চুক্তি হয়নি। স্থানীয় বন কর্মকর্তা বলেন, ‘হাতি পরিযায়ী প্রাণী। কিন্তু তারা এখন দুই দেশের মাঝখানে আটকে পড়েছে।’
- সংঘাতে ক্ষতিপূরণ ও আন্তঃদেশীয় সমঝোতা দরকার
পরিবেশবিদরা বলছেন, করিডোর পুনরুদ্ধার, গেজেট করা, রোহিঙ্গা শিবির স্থানান্তর, বৈদ্যুতিক ফাঁদ বন্ধ এবং সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে একটি যৌথ হাতি সংরক্ষণ চুক্তি স্বাক্ষরের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন,হাতি শুধু একটি প্রাণী নয়, একটি বাস্তুতন্ত্রের প্রহরী। বন নেই মানেই হাতি নেই, আর হাতি নেই মানে বন থাকবে না। কক্সবাজারে হাতির করিডোর শুধু তাদের চলার পথ নয়- এটি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার শেষ চেষ্টাগুলোর একটি। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে, হয়তো আমরা সেই পথও হারিয়ে ফেলব চিরতরে।