মিয়ানমারে চলমান সংঘাত, মানবিক বিপর্যয় এবং রোহিঙ্গাদের সংকট নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপো গ্রান্ডি। নিউইয়র্কে আয়োজিত এ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “এই সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারেই, তাই এর সমাধানও খুঁজতে হবে সেখানেই।”
মিয়ানমারে মানবিক সংকট
গ্রান্ডি বলেন, মিয়ানমার আজ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই সংঘাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, আহত হচ্ছে এবং মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশটির ভেতরে ৫০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত, এর মধ্যে দেড় মিলিয়ন প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
“আমাদের প্রধান চাহিদা হলো, যেখানে সংঘাত চলছে সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে নিরাপদ ও অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা,” বলেন ইউএনএইচসিআর প্রধান।
রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবন
রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আট বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতায় ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রাখাইনে যারা থেকে গেছে তারাও একইভাবে বৈষম্য, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চলাফেরার সীমাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অভাব, এমনকি জোরপূর্বক শ্রম ও নিয়োগের শিকার হচ্ছে।
“রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের জীবন সংজ্ঞায়িত হয় বর্ণবাদ আর ভয়ে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশকে কৃতজ্ঞতা
গ্রান্ডি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে রাখাইনে সংঘাত পুনরায় শুরুর পর আরও ১ লাখ ৫০ হাজার নতুন শরণার্থী বাংলাদেশে নিরাপত্তা খুঁজে নিয়েছে।
“অগণিত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে মানবিক সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তা পুরো বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে- আশ্রয় দেওয়া মানে জীবন রক্ষা করা,” বলেন তিনি।
অর্থায়নের ঘাটতি
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমেই কমছে। খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য মৌলিক খাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। “যদি পর্যাপ্ত সহায়তা না আসে, তবে আমাদের কাটছাঁট করতে হবে, যার মানে হলো শিশুদের অপুষ্টিতে মৃত্যু কিংবা মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথে প্রাণ হারাতে দেখা,” যোগ করেন তিনি।
সমাধান মিয়ানমারে
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন ইউএনএইচসিআর প্রধান। তিনি বলেন, “এই সংকটের সমাধান মানবিক সংস্থা একা করতে পারবে না। আঞ্চলিক ও প্রভাবশালী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারের কার্যত সরকার এবং আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সিরিয়া বা কঙ্গোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, অটল রাজনৈতিক প্রচেষ্টা থাকলে জটিল সংঘাতও পাল্টে দেওয়া যায়। তাই রোহিঙ্গা সংকটেও আমাদের সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ইউএনএইচসিআরের প্রতিশ্রুতি
গ্রান্ডি আশ্বস্ত করেন, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের অন্যান্য বাস্তুচ্যুত জনগণের সুরক্ষা, সহনশীলতা ও টেকসই সমাধানের জন্য ইউএনএইচসিআর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক সংগঠন, সিভিল সোসাইটি এবং শরণার্থী নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাবে।