কক্সবাজার সদর হাসপাতালে শয্যার অভাবে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের। একটু জটিল সমস্যা নিয়ে এলেই তাকে পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়। এতে পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটছে।
অথচ কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরেও অভিভাবকহীনতার কারণে পেলোনা পূর্ণতা । একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজের সাথে থাকার কথা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। ২০ টির মতো বিভাগ। কিন্তু এখনো এর কোনো ছোঁয়াই পায়নি কলেজটি।
২০০৮ সালে জেলা সদর হাসপাতালের পাশে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের। ২০১১ সালে কক্সবাজার শহরের অদূরে জানারঘোনা এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরে ২০১৭ সালে ৩৩ একর জমির উপর নির্মিত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম।
কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ইন্টার্ন ডক্টর’স এসোসিয়েশন-২৪/২৫ প্রেসিডেন্ট ইন্টার্ন ডাক্তার হিসাম বলেন,কলেজ আছে কিন্তু হাসপাতাল নেই। তাই শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য যেতে হয় প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের জেলা সদর হাসপাতালে। যেখানে নানান প্রতিবন্ধকতায় সময় ব্যয় হয় শিক্ষার্থীদের। যথাযথ তদারকির ফলে কমেকের পরে যাত্রা করা একাধিক মেডিক্যাল কলেজ যথাসময়ে হাসপাতালসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা পেয়েছে। কমেকে এখনো মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল না হওয়ায় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে কক্সবাজারের জনগণ এবং বেড়াতে আসা অগণিত পর্যটক।
নামে আধুনিক কলেজ হলেও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে আছে মাত্র দুটি সাদামাটা বাস। সেই সাথে চরম শিক্ষক সংকট, আছে আবাসন সংকট। শূন্য পড়ে আছে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের অধিকাংশ পদ। ওএসডি মূলে ২৩ জন সহকারী অধ্যাপককে কলেজে সংযুক্তি দিলেও মূলত জুনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে কলেজটির কার্যক্রম জোড়াতালি দিয়ে চলছে।
এছাড়া ১০ তলার একাডেমিক ভবনে নির্মাণ হয়েছে ৬ তলা। দুটি ছাত্রাবাসের ছয় তলা করে হওয়ার কথা থাকলেও তিনতলা করেই ফেলে রাখা হয়েছে। যার জন্য কক্ষ সংকটের কারনে শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয় গণরুমে। এতে করে ব্যহত হয় নিয়মিত পড়াশোনা।
ক্ষোভ জানিয়ে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ এর ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী জামি জানান, এটি দুঃখজনক যে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতাল চালু না হওয়া।
কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ এর ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান বলেন, কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। নিউরোসার্জারি, হেমাটোলজি, হেপাটোলজি, সাইকিয়াট্রি, এনআইসিইউ, বার্ন ইউনিটসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ না থাকায় রোগীদের প্রায়ই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়, যা ১৫০ কিলোমিটার দূরে এবং ব্যয়বহুল।
কক্সবাজারের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মেডিকেল কলেজ পূর্ণাঙ্গ হওয়া খুবই প্রয়োজন জানিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীরা বলেন, পূর্নাঙ্গ হলে সবচেয়ে বেশি স্থানীয় জনসাধারনের সেবা নিশ্চিত হবে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। এছাড়াও এখানে সমাগম হয় লাখ লাখ পর্যটকের। সবমিলিয়ে ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতাল খুবই অপ্রতুল। যেখানে নির্ধারিত আসনের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। তাই কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবী উঠেছে ফের।
পূর্ণাঙ্গ হওয়ার প্রত্যাশার প্রহর গুণতে গুণতেই দুর্ভোগ সাথী করেই বিদায় নিয়েছে কলেজের ১২ টি ব্যাচ। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয় নানামুখী সংকটের কারনে দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষকদেরও জানিয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জেনারেল সার্জারী ডা. শাহ আলম বলেন, পুনাঙ্গ করার কাজ কিছুটা অগ্রগতি হলেও, ৫ আগস্টের পর থমকে গেছে।
কলেজ প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর আর মূল ক্যাম্পাসের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনের ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখলোনা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত বা স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি করতে কক্সবাজারে এই প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণাঙ্গতা পাওয়া যেন কক্সবাজার বাসির প্রাণের দাবী।
এদিকে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ৫০০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল দ্রুত নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুর ১২টায় কলেজ ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, “২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও দীর্ঘ ১৭ বছরেও স্থায়ী ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মিত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য।”
তারা আরও জানান, কক্সবাজারের প্রায় ২৮ লাখ মানুষের জন্য বর্তমানে মাত্র ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এছাড়া, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাড়তি চাপও রয়েছে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
শিক্ষার্থীরা জোরালোভাবে দাবি জানান, “আধুনিক ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মিত হলে কক্সবাজারের জনগণ ও পর্যটকদের জন্য উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত হবে এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।”
উল্লেখ্য : স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয় ২০১০ সালের নভেম্বরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালকে অস্থায়ী কমেক হাসপাতাল ঘোষনা করে। তখন থেকে এখানেই ইন্টার্ণরা ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ এবং রোগীকে সেবা দিচ্ছেন। ২০১৭ সালের ৬ মে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও অদ্যাবধি এর নির্মাণ শুরু হয়নি।