কক্সবাজারের রামুর মরিচ্যা চেকপোস্টে তিন নারীর শরীরে বিশেষ কৌশলে লুকানো ১ লাখ ১৪ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দুপুরে ৩০ বিজিবির একটি বিশেষ টহল দল গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রামুর খুনিয়াপালংয়ের গোয়ালিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা থামিয়ে যাত্রীদের তল্লাশিতে মিলে ইয়াবা।
এসময় আটক নারীরা হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম রংগীখালীর বাসিন্দা সাবেকুন নাহার (৪০), আমিনা আক্তার (৩০) ও সুমাইয়া আক্তার (২১)।
বাড়ছে নারীদের সম্পৃক্ততা
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন বছরে কক্সবাজার জেলায় ইয়াবা পাচারে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
সীমান্তঘেঁষা এই জেলার রোহিঙ্গা শিবির, পাহাড়ি এলাকা ও সমুদ্রপথকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সুসংগঠিত মাদকচক্র। যারা নারীদের ব্যবহার করছে পাচারের ‘সেফ করিডোর’ হিসেবে।
২০২২ সালের মাঝামাঝি হোয়াইক্যং ক্যাম্প-২১ থেকে রোহিঙ্গা নারী সাজিদা বেগমকে ৬০ পিস ইয়াবা ও ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ আটক করে এপিবিএন।একই বছর আরও কয়েকজন নারীর নাম উঠে আসে কয়েকটি মাদক মামলায়।
২০২৩ সালে কোটবাজারে অভিযানে তিন রোহিঙ্গা নারী নুর বেগম, জুলেখা বেগম ও হামিদা বেগম ধরা পড়েন ৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ। একই বছর যমুনা ধর নামে এক নারী ধরা পড়েন ১ হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা নিয়ে।
২০২৪ সালের মে মাসে টেকনাফের সাবরাংয়ে নিজ ঘর থেকে ৬০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন আসমা আক্তার। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিমছড়ির একটি হোটেল থেকে গাজীপুরের মিনারা আক্তার ও লায়লীকে ১০ হাজার ইয়াবা ও ৫০০ গ্রাম হেরোইনসহ ধরা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি এক্স-রে করে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ধরা পড়ে দুই বোন- উম্মে হাবিবা ও উম্মে জামিলা। যাদের পেট থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৪ হাজার পিস ইয়াবা। সবশেষ ৯ জুলাই বিজিবির অভিযানে টেকনাফের মির্জাযোরা থেকে রুজিনা বেগমের ঘরে মেলে ৮১ হাজার ১৩৩ পিস ইয়াবা ও নগদ অর্থ। এর আগে ২৪ মে ছেনুয়ারা বেগম আটক হন ৭০ হাজার ইয়াবাসহ। ২৬ জুন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা নারী গোলজাহার ও কুলছুম ধরা পড়েন ৯০ হাজার ইয়াবাসহ।
কেন নারীরা?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নারী পাচারকারীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ কম হওয়ায় মাদকচক্রের আস্থাভাজন হয়ে উঠছেন তারা। অনেকে আবার অর্থনৈতিক চাপে পড়ে বা পারিবারিক কারণে এই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হক বলেন, ‘নারীরা ইয়াবা শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে বহন করে থাকেন। যেমন- অন্তর্বাস, কোমরবন্ধনী এমনকি কখনো পেটের ভেতরেও ইয়াবা পাচারের নজির পাওয়া গেছে।’
সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ
স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, কক্সবাজারের সীমান্ত ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক চক্র নারীদের পুরোদমে ব্যবহার করছে। টেকনাফ-উখিয়া-রামু হয়ে ইয়াবা পৌঁছায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা পর্যন্ত। সামাজিক বা পারিবারিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা নারীদের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঠেলে দিচ্ছে।
ধীর বিচার, বাড়ছে পুনরাবৃত্তি
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক মামলার বিচারপ্রক্রিয়া ধীরগতির। জামিনে ছাড়া পেয়েই অনেক নারী আবারও চক্রে জড়াচ্ছেন।’ তাঁর মতে, কেবল আইন প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গা শিবিরে নিয়ন্ত্রণ জোরদার।
মাদকবিরোধী সংগঠন ‘স্বপ্নের আলো’র সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক নারী ও কিশোরী পারিবারিক চাপে বা চক্রের পুরনো সদস্যদের প্ররোচনায় এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এটা এখন কৌশলগত সংগঠিত অপরাধে পরিণত হয়েছে।’
স্থানীয়দের বিশ্লেষণ
এই চিত্র স্পষ্ট করে দেয়, ইয়াবা পাচারে নারীদের ব্যবহার এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি সুসংগঠিত ও কৌশলগত পদ্ধতির অংশ, যেখানে নারীদের দুর্বলতা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিস্তৃত এক মাদক নেটওয়ার্ক। এই প্রবণতা রোধে কেবল আইনগত পদক্ষেপ নয়, জরুরি সামাজিক সচেতনতা, নারীশিক্ষা, বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি ও রোহিঙ্গা শিবির নিয়ন্ত্রণের বাস্তবায়ন।
বড় হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে?
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চক্রগুলো এখন নারী পাচারকারীদের কাজে লাগাতে নতুন কৌশল নিচ্ছে। তবে আমরা শুধু বহনকারীদের ধরায় সন্তুষ্ট নই, মূল হোতাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি।’