ঢাকা ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
রাখাইনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে: ড. খলিলুর রহমান রামু বাইপাসে ‘খালেকুজ্জামান চত্বর’ পূনর্বহালের দাবিতে হাজারো মানুষের মানববন্ধন খালেদা জিয়া নারী শিক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন: রামুতে কাজল ভারতে থালাপতি বিজয়ের জনসভায় পদদলিত হয়ে নারী-শিশুসহ অন্তত ৩৬ জন নিহত ঐক্যবদ্ধ না হলে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব হবে : তারেক রহমান সাংবাদিকদের ৩টি কলিজা লাগে: জামায়াত আমির তারা নাকি জান্নাতের টিকিট দেবে, নাউজুবিল্লাহ: সালাহউদ্দিন আহমদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলেই কি কক্সবাজারে পর্যটনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে? রোহিঙ্গা ছাড়া জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সম্মেলন: ‘নায়ক ছাড়া নাটক’ মন্তব্য কক্সবাজার সৈকত দখল ও অব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে দুষছে টুরিস্ট পুলিশ টেকনাফে মাটি খুঁড়ে মিললো ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা প্রত্যাবাসন চাই- জাতিসংঘে সম্মেলনের আগে ক্যাম্পে সমাবেশ করে বিশ্বকে রোহিঙ্গাদের বার্তা অবহেলার বোঝা নামিয়ে টেকসই ভবিষ্যতের ডাক চায় সিসিএডি ‘কংক্রিটের ফাঁদে’ কক্সবাজারের পর্যটন: কেনো আসেনা বিদেশিরা? চিকিৎসাধীন ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক জান্নাতুল নাঈমের মৃত্যু

‘কংক্রিটের ফাঁদে’ কক্সবাজারের পর্যটন: কেনো আসেনা বিদেশিরা?

‘বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত’ ঘিরে গড়ে ওঠা কক্সবাজারের পর্যটন এখন এক ধরনের ‘কংক্রিটের ফাঁদে’ আটকে আছে। সারাবছর দেশীয় পর্যটকের ভিড়ে সরগরম থাকলেও এখানে বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়। যারা আসেন, তাদের ভরসা থাকে কেবল সমুদ্রের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা, সেটুকুই। সৈকত ছাড়া নেই কোনো আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন, নেই প্রকৃতি নির্ভর টেকসই পর্যটনের ব্যবস্থা।

কংক্রিটের ভিড়, নেই বিদেশী পর্যটক

সরকারি হিসেবে কক্সবাজারে নিবন্ধিত হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা প্রায় ৬০০। আর কক্সবাজার হোটেল–গেস্টহাউস মালিক সমিতির জানিয়েছে, সমুদ্রসৈকতের পাশে শহরের কলাতলীতে মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যেই গড়ে উঠেছে ৫৩৮টি হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজ।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর তথ্য বলছে, কক্সবাজারে প্রতি পিক সিজনে দেশী পর্যটকের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। অথচ বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বছরে কতো তার কোনো তথ্যই জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল। তারকা মানের হোটেল দি কক্স টুডে’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবু তালেব জানান, গেলো একবছরে তাদের হিসেবের খাতায় বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই শূণ্যের কোটায়।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, কক্সবাজারে পর্যটনের মূল আকর্ষণ প্রকৃতি হলেও তা রক্ষায় নেই সমন্বিত উদ্যোগ। সৈকতকে ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল হোটের ও রেস্টুরেন্ট। কিন্তু প্রকৃতি নির্ভর বিনোদন বা ইকো ট্যুরিজম নেই বললেই চলে। মহেশখালী, সোনাদিয়া, ইনানী কিংবা হিমছড়ির মতো জায়গাগুলো পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা রাখলেও তা ভরসা করে এগোয়নি কোনো উদ্যোগ।

সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, “কক্সবাজারে পরিকল্পনাহীন হোটেল বানানোই এখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে। অথচ প্রকৃতি নির্ভর ট্যুরিজমই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান দিতে পারে। বিদেশিরা কেবল কংক্রিট দেখতে আসবে না, তারা আসবে প্রকৃতির টানে, সংস্কৃতির টানে।”

কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মইনুল হাসান পলাশ বলেন, “কক্সবাজারের পর্যটন শুরু থেকেই পরিকল্পনাহীন ও অগোছালো। মানসম্মত দেশীয় পর্যটনও গড়ে উঠতে পারেনি। কারণ অনেক; কোনো সরকারই পর্যটনকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দেয়নি। সবচেয়ে বড় প্রমাণ স্বতন্ত্র পর্যটন মন্ত্রণালয় না থাকা।

“মানসম্মত দেশীয় পর্যটন গড়ে উঠলে তার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক পর্যটন দাঁড়ায়। বিদেশি পর্যটক আনা দিন দিন আরও দুরুহ হয়ে পড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “পর্যটন একটি সেবা, সেবার মান উন্নত না হলে শুধু অবকাঠামো গড়ে টেকসই পর্যটন সম্ভব নয়। বিদেশি অতিথিরা এখানে শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকতে আসবে না, তারা আসবে বাংলাদেশকে দেখতে, অনুভব করতে। সেই সুযোগ দিতে না পারলে পর্যটন মারা যেতে পারে।”

ভুটান ও মালদ্বীপের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক মইনুল হাসান পলাশ বলেন, বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে হলে শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, গুণমান, বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, পরিবেশ সচেতন নীতি ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং দরকার। কক্সবাজারে যদি দেশের পর্যটন খাতকে ভরসাযোগ্য মঞ্চে উন্নত করা যায়, তবে বিদেশি পর্যটকও আসবে।

উদ্যোগহীন ইকো ট্যুরিজম, নেই বিনোদন সুবিধা

কক্সবাজারে সরকারি পর্যায়ে ইকো ট্যুরিজমের নামে ছোটখাটো কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যত প্রাণহীন। স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বড় কোনো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে, পর্যটকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন ছাড়া কোনো ভিন্ন অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন না।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “আমরা কেবল হোটেল বানানো আর জমির দাম বাড়ানো নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু বিদেশি পর্যটক চাইলে তাকে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, মানসম্মত সেবা ও আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা দিতে হবে। টেকসই পর্যটনের জন্য সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান দরকার। না হলে এই শহর শুধু দেশীয় ভিড়েই আটকে যাবে, বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না।”

কক্সবাজারের পর্যটনসেবী কলিম উল্লাহ মনে করেন, বিদেশি পর্যটক না আসার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার ভাষায়, “প্রথমত, নিরাপত্তার বিষয়টি বিদেশিদের কাছে এখনো একটি বড় ইস্যু। তাদের জন্য কোনো এক্সক্লুসিভ জোন বা নিরাপদ পরিবেশ নেই। দ্বিতীয়ত, রাতের বেলায় কোনো বিনোদনের সুযোগ নেই, না নাইটলাইফ, না আন্তর্জাতিক মানের ইভেন্ট। সৈকতও অনেক সময় অপরিচ্ছন্ন থাকে, যা বিদেশিদের কাছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমনকি এখানে সান বাথের মতো মৌলিক পর্যটন সুবিধাও নেই। ফলে যারা আসেন, তারা একবার ঘুরে গিয়ে আর ফিরে আসতে চান না।”

সৈকত ও হোটেল নিয়েও পর্যটকদের উষ্মা

ঢাকার বারিধারা থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন মোকাম্মেল হোসেন। সমুদ্র সৈকতের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “এখানে মনে হয় কিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। যেখানে-সেখানে দোকানপাট, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের ভিড়ে হাঁটাচলাই দায়।”

তিনি অভিযোগ করেন, সৈকতে অসংখ্য কীটকট আর ছাতার সারি পর্যটকদের চলাচলে বাধা তৈরি করছে। শুক্রবার সুগন্ধা পয়েন্টে কয়েক হাজার পর্যটকের ভিড় দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, “এত মানুষ সমুদ্রে নামছে অথচ নেই কোনো আধুনিক চেঞ্জিং রুম বা গোসলের ব্যবস্থা। ক’টা অস্বাস্থ্যকর ঘর বানিয়ে লোকজন বাথরুম ও গোসল করাচ্ছে, কিন্তু ওগুলোর ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না।”

আবাসন ও যানবাহনের ভাড়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। “এখানে যে টাকা খরচ করতে হয়, তাতে অনায়াসে বিদেশ ভ্রমণ সম্ভব,” বলেন মোকাম্মেল।

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী জামশেদ হোসাইন জানান, রাত গভীর হলে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হোটেল-মোটেল জোনের নির্জন জায়গাগুলোও নিরাপদ নয় বলে দাবি তার।

তিনি আরও বলেন, ট্যুরে এসে মানুষ খোলা জায়গায় থাকতে চায়, কিন্তু এখানে হোটেল-মোটেল জোনের অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রামের কোনো আবাসিক এলাকা থেকে কম নয়। দেখে মনে হয় সব হোটেল এক-দুই কিলোমিটারের ভেতরে গড়ে তোলা হলো?”

আইনজীবী প্রতিভা দাশ সম্প্রতি থাইল্যান্ড ভ্রমণ করে এসেছেন। তিনি বলেন, “থাইল্যান্ডে সমুদ্রপাড়ে হাঁটার ও বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কক্সবাজারে এমন কিছু চোখে পড়ে না।”

কক্সবাজারের স্থানীয় হলেও তার অভিযোগ, মেরিন ড্রাইভ আকর্ষণীয় হলেও সেখানে যাওয়া কঠিন, রাতে তো প্রায় অসম্ভবই।

ভ্রাম্যমাণ দোকান ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনা

জনপ্রিয় সৈকতগুলোতে দেখা গেছে, যত্রতত্র ভ্রাম্যমাণ দোকানের সারি। প্রতিদিনই যেন দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এসব দোকানকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সাম্প্রতিক সৈকতের বালিয়াড়িতে নতুন ভ্রাম্যমান দোকানের প্রশাসনের অনুমতি নিয়েও উঠেছে সমালোচনা।

এছাড়া সৈকতের বিভিন্ন অংশে চোখে পড়ে প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট, পানির গ্লাস, সিগারেটের ফিল্টার, এমনকি পলিথিনের স্তূপ। স্থানীয়দের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন নেই বলেই মানুষ বাধ্য হয়ে যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলছে। এমনকি অনেক হোটেল রেস্তোরাঁ থেকেও প্রতিদিন প্রচুর বর্জ্য সরাসরি সৈকতে চলে আসে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, হোটেল-মোটেল জোনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই, ফলে সরাসরি সেই বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ ও জনস্বার্থ দুই-ই হুমকিতে।

কক্সবাজার হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, “হোটেল-মোটেল জোনের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলায় বর্ষায় পর্যটকদের ভোগান্তি চরমে ওঠে। সুষ্ঠু পরিকল্পনায় উন্নত সেবা দিলে এ শিল্প সমৃদ্ধ হবে।”

সেন্ট মার্টিনেও একই চিত্র

কক্সবাজার ছাড়াও সেন্ট মার্টিনেও পরিকল্পনাহীনভাবে ২০০টির বেশি হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সরকার নভেম্বর থেকে প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার পর্যটককে দ্বীপে ভ্রমণের অনুমতি দেয়, রাত যাপনও সীমিত সময়ের জন্য।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ তানভীর হাসান রেজাউল জানান, নতুন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে, যা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

তবে ব্যক্তিগত মত জানিয়ে তিনি বলেন, “অপরিকল্পিত স্থাপনা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।

টেকসই ভবিষ্যতের প্রশ্ন

বর্তমানে স্থানীয় পর্যটন দেশের অর্থনীতিতে বড় কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি পর্যটক না আসা পর্যন্ত এ খাত অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে না। দিনে দিনে মানুষের জীবনযাত্রা যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, তারা চায় নিরিবিলি প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতামূলক ভ্রমণ।

অধ্যাপক পলাশের মতে, “বাংলাদেশের পর্যটনের প্রাণ হলো প্রকৃতি। প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে ট্যুরিজম না গড়ে তুললে কক্সবাজার ক্রমে কেবল কংক্রিটের ভিড়েই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।”

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

রাখাইনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে: ড. খলিলুর রহমান

This will close in 6 seconds

‘কংক্রিটের ফাঁদে’ কক্সবাজারের পর্যটন: কেনো আসেনা বিদেশিরা?

আপডেট সময় : ০২:১৯:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত’ ঘিরে গড়ে ওঠা কক্সবাজারের পর্যটন এখন এক ধরনের ‘কংক্রিটের ফাঁদে’ আটকে আছে। সারাবছর দেশীয় পর্যটকের ভিড়ে সরগরম থাকলেও এখানে বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়। যারা আসেন, তাদের ভরসা থাকে কেবল সমুদ্রের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা, সেটুকুই। সৈকত ছাড়া নেই কোনো আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন, নেই প্রকৃতি নির্ভর টেকসই পর্যটনের ব্যবস্থা।

কংক্রিটের ভিড়, নেই বিদেশী পর্যটক

সরকারি হিসেবে কক্সবাজারে নিবন্ধিত হোটেল-মোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা প্রায় ৬০০। আর কক্সবাজার হোটেল–গেস্টহাউস মালিক সমিতির জানিয়েছে, সমুদ্রসৈকতের পাশে শহরের কলাতলীতে মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যেই গড়ে উঠেছে ৫৩৮টি হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজ।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর তথ্য বলছে, কক্সবাজারে প্রতি পিক সিজনে দেশী পর্যটকের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। অথচ বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বছরে কতো তার কোনো তথ্যই জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল। তারকা মানের হোটেল দি কক্স টুডে’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবু তালেব জানান, গেলো একবছরে তাদের হিসেবের খাতায় বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই শূণ্যের কোটায়।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, কক্সবাজারে পর্যটনের মূল আকর্ষণ প্রকৃতি হলেও তা রক্ষায় নেই সমন্বিত উদ্যোগ। সৈকতকে ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল হোটের ও রেস্টুরেন্ট। কিন্তু প্রকৃতি নির্ভর বিনোদন বা ইকো ট্যুরিজম নেই বললেই চলে। মহেশখালী, সোনাদিয়া, ইনানী কিংবা হিমছড়ির মতো জায়গাগুলো পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা রাখলেও তা ভরসা করে এগোয়নি কোনো উদ্যোগ।

সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, “কক্সবাজারে পরিকল্পনাহীন হোটেল বানানোই এখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে। অথচ প্রকৃতি নির্ভর ট্যুরিজমই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান দিতে পারে। বিদেশিরা কেবল কংক্রিট দেখতে আসবে না, তারা আসবে প্রকৃতির টানে, সংস্কৃতির টানে।”

কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মইনুল হাসান পলাশ বলেন, “কক্সবাজারের পর্যটন শুরু থেকেই পরিকল্পনাহীন ও অগোছালো। মানসম্মত দেশীয় পর্যটনও গড়ে উঠতে পারেনি। কারণ অনেক; কোনো সরকারই পর্যটনকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দেয়নি। সবচেয়ে বড় প্রমাণ স্বতন্ত্র পর্যটন মন্ত্রণালয় না থাকা।

“মানসম্মত দেশীয় পর্যটন গড়ে উঠলে তার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক পর্যটন দাঁড়ায়। বিদেশি পর্যটক আনা দিন দিন আরও দুরুহ হয়ে পড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “পর্যটন একটি সেবা, সেবার মান উন্নত না হলে শুধু অবকাঠামো গড়ে টেকসই পর্যটন সম্ভব নয়। বিদেশি অতিথিরা এখানে শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকতে আসবে না, তারা আসবে বাংলাদেশকে দেখতে, অনুভব করতে। সেই সুযোগ দিতে না পারলে পর্যটন মারা যেতে পারে।”

ভুটান ও মালদ্বীপের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক মইনুল হাসান পলাশ বলেন, বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে হলে শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, গুণমান, বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, পরিবেশ সচেতন নীতি ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং দরকার। কক্সবাজারে যদি দেশের পর্যটন খাতকে ভরসাযোগ্য মঞ্চে উন্নত করা যায়, তবে বিদেশি পর্যটকও আসবে।

উদ্যোগহীন ইকো ট্যুরিজম, নেই বিনোদন সুবিধা

কক্সবাজারে সরকারি পর্যায়ে ইকো ট্যুরিজমের নামে ছোটখাটো কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যত প্রাণহীন। স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বড় কোনো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে, পর্যটকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন ছাড়া কোনো ভিন্ন অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন না।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “আমরা কেবল হোটেল বানানো আর জমির দাম বাড়ানো নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু বিদেশি পর্যটক চাইলে তাকে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, মানসম্মত সেবা ও আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা দিতে হবে। টেকসই পর্যটনের জন্য সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান দরকার। না হলে এই শহর শুধু দেশীয় ভিড়েই আটকে যাবে, বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না।”

কক্সবাজারের পর্যটনসেবী কলিম উল্লাহ মনে করেন, বিদেশি পর্যটক না আসার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার ভাষায়, “প্রথমত, নিরাপত্তার বিষয়টি বিদেশিদের কাছে এখনো একটি বড় ইস্যু। তাদের জন্য কোনো এক্সক্লুসিভ জোন বা নিরাপদ পরিবেশ নেই। দ্বিতীয়ত, রাতের বেলায় কোনো বিনোদনের সুযোগ নেই, না নাইটলাইফ, না আন্তর্জাতিক মানের ইভেন্ট। সৈকতও অনেক সময় অপরিচ্ছন্ন থাকে, যা বিদেশিদের কাছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমনকি এখানে সান বাথের মতো মৌলিক পর্যটন সুবিধাও নেই। ফলে যারা আসেন, তারা একবার ঘুরে গিয়ে আর ফিরে আসতে চান না।”

সৈকত ও হোটেল নিয়েও পর্যটকদের উষ্মা

ঢাকার বারিধারা থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন মোকাম্মেল হোসেন। সমুদ্র সৈকতের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “এখানে মনে হয় কিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। যেখানে-সেখানে দোকানপাট, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের ভিড়ে হাঁটাচলাই দায়।”

তিনি অভিযোগ করেন, সৈকতে অসংখ্য কীটকট আর ছাতার সারি পর্যটকদের চলাচলে বাধা তৈরি করছে। শুক্রবার সুগন্ধা পয়েন্টে কয়েক হাজার পর্যটকের ভিড় দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, “এত মানুষ সমুদ্রে নামছে অথচ নেই কোনো আধুনিক চেঞ্জিং রুম বা গোসলের ব্যবস্থা। ক’টা অস্বাস্থ্যকর ঘর বানিয়ে লোকজন বাথরুম ও গোসল করাচ্ছে, কিন্তু ওগুলোর ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না।”

আবাসন ও যানবাহনের ভাড়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। “এখানে যে টাকা খরচ করতে হয়, তাতে অনায়াসে বিদেশ ভ্রমণ সম্ভব,” বলেন মোকাম্মেল।

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী জামশেদ হোসাইন জানান, রাত গভীর হলে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হোটেল-মোটেল জোনের নির্জন জায়গাগুলোও নিরাপদ নয় বলে দাবি তার।

তিনি আরও বলেন, ট্যুরে এসে মানুষ খোলা জায়গায় থাকতে চায়, কিন্তু এখানে হোটেল-মোটেল জোনের অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রামের কোনো আবাসিক এলাকা থেকে কম নয়। দেখে মনে হয় সব হোটেল এক-দুই কিলোমিটারের ভেতরে গড়ে তোলা হলো?”

আইনজীবী প্রতিভা দাশ সম্প্রতি থাইল্যান্ড ভ্রমণ করে এসেছেন। তিনি বলেন, “থাইল্যান্ডে সমুদ্রপাড়ে হাঁটার ও বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কক্সবাজারে এমন কিছু চোখে পড়ে না।”

কক্সবাজারের স্থানীয় হলেও তার অভিযোগ, মেরিন ড্রাইভ আকর্ষণীয় হলেও সেখানে যাওয়া কঠিন, রাতে তো প্রায় অসম্ভবই।

ভ্রাম্যমাণ দোকান ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনা

জনপ্রিয় সৈকতগুলোতে দেখা গেছে, যত্রতত্র ভ্রাম্যমাণ দোকানের সারি। প্রতিদিনই যেন দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এসব দোকানকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সাম্প্রতিক সৈকতের বালিয়াড়িতে নতুন ভ্রাম্যমান দোকানের প্রশাসনের অনুমতি নিয়েও উঠেছে সমালোচনা।

এছাড়া সৈকতের বিভিন্ন অংশে চোখে পড়ে প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট, পানির গ্লাস, সিগারেটের ফিল্টার, এমনকি পলিথিনের স্তূপ। স্থানীয়দের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন নেই বলেই মানুষ বাধ্য হয়ে যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলছে। এমনকি অনেক হোটেল রেস্তোরাঁ থেকেও প্রতিদিন প্রচুর বর্জ্য সরাসরি সৈকতে চলে আসে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, হোটেল-মোটেল জোনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই, ফলে সরাসরি সেই বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ ও জনস্বার্থ দুই-ই হুমকিতে।

কক্সবাজার হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, “হোটেল-মোটেল জোনের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলায় বর্ষায় পর্যটকদের ভোগান্তি চরমে ওঠে। সুষ্ঠু পরিকল্পনায় উন্নত সেবা দিলে এ শিল্প সমৃদ্ধ হবে।”

সেন্ট মার্টিনেও একই চিত্র

কক্সবাজার ছাড়াও সেন্ট মার্টিনেও পরিকল্পনাহীনভাবে ২০০টির বেশি হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সরকার নভেম্বর থেকে প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার পর্যটককে দ্বীপে ভ্রমণের অনুমতি দেয়, রাত যাপনও সীমিত সময়ের জন্য।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ তানভীর হাসান রেজাউল জানান, নতুন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে, যা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

তবে ব্যক্তিগত মত জানিয়ে তিনি বলেন, “অপরিকল্পিত স্থাপনা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।

টেকসই ভবিষ্যতের প্রশ্ন

বর্তমানে স্থানীয় পর্যটন দেশের অর্থনীতিতে বড় কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি পর্যটক না আসা পর্যন্ত এ খাত অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে না। দিনে দিনে মানুষের জীবনযাত্রা যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, তারা চায় নিরিবিলি প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতামূলক ভ্রমণ।

অধ্যাপক পলাশের মতে, “বাংলাদেশের পর্যটনের প্রাণ হলো প্রকৃতি। প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে ট্যুরিজম না গড়ে তুললে কক্সবাজার ক্রমে কেবল কংক্রিটের ভিড়েই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।”