কক্সবাজারের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে এবার নিরীক্ষা প্রতিবেদন হাতে এসেছে আমাদের হাতে। সালাউদ্দিনের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে টিটিএনে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চলতি বছরের শুরুতে।
কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফের পরিবর্তন আসে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়ও। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকটা জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান। অভিযোগ আছে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন সময়ে মুজিবকে প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করেন সালাউদ্দিন। এনিয়ে চলে মামলা-মোকদ্দমা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘিরে সালাউদ্দিনের নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের উপর নিরীক্ষা (অডিট) করেছে এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান নাছির মোহাম্মদ এন্ড কোম্পানি। যারা দীর্ঘ তদন্ত করে তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনটি হাতে এসেছে টিটিএনের।
প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিতে হেরফের করলেও সালাউদ্দিনের বাড়ির ব্যক্তিগত কর্মচারীর বেতন পর্যন্ত যেতো এখানকার তহবিল থেকে।
অর্থ বিভাগে উপপরিচালক হিসেবে নিজের লোক বসিয়ে এসব অনিয়ম দেদারসে করে গেছেন আওয়ামীলীগের রাজনীতি করে যাওয়া প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ। যা নিয়ে টিটিএনে একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে বহাল তবিয়তে রাখা হয়েছিলো সেই উপপরিচালককে।
প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, অবৈধ পন্থায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, ভুয়া বিল ভাউচার তৈরীর মাধ্যমে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাত করেন সালাউদ্দিনসহ তার নিয়ন্ত্রণে থাকা উপাচার্যসহ ট্রাস্টি বোর্ডের অনেকে।
যার ভিত্তিতে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান লায়ন মুজিবুর রহমান। এতে আসামী করা হয়েছে সালাহউদ্দিন আহমদসহ আরাও ৫ জনকে।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) কক্সবাজার সিনিয়র স্পেশাল জজ মুন্সি আব্দুল মজিদের আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলাটি আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
বাদী পক্ষের আইনজীবীদের একজন রাশেদুল ইসলাম মুন্না মুঠোফোনে টিটিএনকে জানান, সালাহউদ্দিন আহমদ ছাড়াও মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন, সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আয়েশা সালাহউদ্দিন, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এ.কে.এম গিয়াস উদ্দীন, উপাচার্য (প্রাক্তন) গোলাম কিবরিয়া ভুঁইয়া ও প্রাক্তন সহকারী পরিচালক (অর্থ) মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম চৌধুরী।
যেখানে গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে এর আগেও বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে অননুমোদিত সেন্টার খুলে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসি। যা নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো টিটিএনে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সালাহউদ্দিনের একক নিয়ন্ত্রণে গঠিত অবৈধ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কোন ধরনের বোর্ড সভা না করে নানান ভাবে স্বাক্ষর নিয়ে বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রতিবেদন উল্লেখ করতো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০, অধীনে নিয়োগ বিধি তোয়াক্কা না করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গাড়ীর ড্রাইভার, পিয়ন নিয়োগ দেয়া হতো। যা ইউজিসির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিলো। কিন্তু এনিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তৎকালীন সময়ে।
এছাড়াও একক নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত ড্রাইভার ও পিয়ন, ব্যক্তিগত সহকারীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ট্রাস্টের আয় হতে ইচ্ছা মাফিক ভুয়া বিল ভাউচার, বেতন উত্তোলন করা হতো। এমনকি সালাউদ্দিন নিজের বাসা বাড়ির কর্মচারীর বেতন, সফর বিনোদনের বিলও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিতেন। যা তিনি করতেন অর্থ বিভাগের উপপরিচালকের মাধ্যমে। ৫ আগস্টের পর থেকে সেই উপপরিচালক শহিদুলকে আর পাওয়া যায়নি।
এদিকে মামলার বাদী লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান টিটিএনকে মুঠোফোনে জানান, যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নতুন করে যেনো কোনো অনিয়ম না হয় সে বিষয়ে তদারক করা হচ্ছে৷ এমনকি ইউজিসির নিয়ম মেনেই ৫ আগস্ট পরবর্তী সকল নিয়োগ হচ্ছে বলে দাবী করেন তিনি।
লায়ন মুজিব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ৭ বছর ধরে সুনামের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব ও অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করে ২০২০ সালের ২ জুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দিয়ে ইউনিভার্সিটি জবরদখল করে সেখানে লুটপাট শুরু করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ বোর্ড অব ট্রাস্টিদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কমিটিতে পরিণত করা হয় ট্রাস্টি বোর্ডকে। যারা নিজেদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা উত্তোলনসহ নানা ধরণের দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে সালাউদ্দিন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব উঠে আসার বিষয়ে জোর দেন মুজিব।
বাদী পক্ষের আইনজীবী রাশেদুল ইসলাম মুন্না মুঠোফোনে টিটিএনকে বলেন, ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ২ কোটি ৪৮ লক্ষ ৪৬ হাজার ৪০১ টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে। যার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করা হয়েছে।
লায়ন মুজিব আরো দাবী করেন, ২০১৩ সালের ১২ জুন কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। পরবর্তীতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর অধীনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সব দপ্তর তাকে “প্রতিষ্ঠাতা” উল্লেখ সূচিপত্র ইস্যু করে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপির সাথেও নানান ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনভাবে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি ওই সময়কালে ট্রাস্ট্রি বোর্ডের দায়িত্বে থাকা একাধিক সদস্যের সাথেও যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হয় টিটিএনের পক্ষ থেকে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। ট্রাস্টি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তারা সকলে আত্মগোপনে রয়েছেন বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে।