তথ্য বলছে— প্লে-মেকিংয়ে জিনেদিন জিদান নিখুঁত, গোলসংখ্যায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো রাজা, ট্রফির গামলা নিয়ে আছেন লিওনেল মেসি। পেলের ঝুলিতে তিনটি বিশ্বকাপ, সাতশো’র বেশি গোল। কিন্তু এই সব হিসেব মেলাতে বসলে ম্যারাডোনার নামটা কোথাও উপরে দেখা যায় না। কারণ, গ্রেটনেস পরিসংখ্যানে মাপে না — গ্রেটনেস মাপে সময়, প্রভাব, এবং এক মানুষের বিপ্লবী উপস্থিতি দিয়ে। আর সেই কারণেই, ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছিলেন এক যুগের প্রতিচ্ছবি, যার শরীরে ছিল ঈশ্বরের ছোঁয়া।
রোনালদিনহোর ৩৫৫ গোল, কাকার ব্যালন ডি’অর, রিভালদোর গোল্ডেন বুট — এগুলো ফুটবলের পরিসংখ্যানিক গৌরব। কিন্তু ম্যারাডোনা ছিলেন প্রমাণ যে ফুটবল এক বিশ্বাস, শুধু খেলা নয়। কোনো ডিফেন্সকে একার হাতে বিধ্বস্ত করা, একা হাতে মিড-টেবিল ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন বানানো — এগুলো কোনো ডেটা নয়, এগুলো ইতিহাস।
১৯৮৪ সালের সেই দুপুরে ইতালির ছোট্ট শহর নাপোলিতে যখন ২৩ বছর বয়সী এক লাতিনো তরুণ মাইক্রোফোনে বললেন, “আমি এসেছি এখানে ইতিহাস লিখতে,” তখন কেউ কল্পনাও করেনি, তিনি সত্যিই ইতিহাস লিখবেন। নাপোলির জন্য সিরি আ’র প্রথম ট্রফি ১৯৮৭ সালে আসে ম্যারাডোনার পায়ে ভর করে। তারপর ইউরোপা কাপ জয়, পুনরায় লিগ শিরোপা — একক নেতৃত্বে দক্ষিণ ইতালির শহর নাপোলি উঠে আসে মানচিত্রের শীর্ষে।
কিন্তু এই জয় শুধু ফুটবল ছিল না — এটি ছিল উত্তর বনাম দক্ষিণ ইতালির শ্রেণি ও সম্মানের যুদ্ধ। উত্তরের ক্লাবগুলো যেখানে অর্থ, রাজনীতি ও মিডিয়ার ক্ষমতায় ভরপুর; নাপোলির মানুষ ছিল অবহেলিত, বিদ্রুপে জর্জরিত। আর সেই হীনমন্য শহরে ম্যারাডোনা এনে দেন সম্মানের আলো। রাস্তার দেয়ালে তখন লেখা থাকতো— “তোমরা জানো না, কী হারিয়েছ!” নেপলসের ছোট দোকান, গির্জা, অলিগলি— সবখানে দেখা যেত ম্যারাডোনার ছবি, মোমবাতি, প্রার্থনা। কারণ, তিনি শুধু গোল দেননি, একটি জাতিকে আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি গোল — প্রথমটি হ্যান্ড অফ গড, দ্বিতীয়টি গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি। একটি লুকোনো হাতের ছোঁয়া, অন্যটি ৬০ গজ দৌড়ে পাঁচজনকে কাটিয়ে ঈশ্বরীয় গোল। এই দুই মুহূর্তেই ম্যারাডোনা প্রমাণ করেছিলেন — ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটি ছিল এক জাতির প্রতিশোধ, এক ইতিহাসের পরিশুদ্ধি।
ম্যারাডোনা পরে বলেছিলেন, “আমরা শুধু ইংল্যান্ডকে হারাইনি, আমরা পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁদিয়েছিলাম।”
তিনি নিখুঁত ছিলেন না। কোকেইন, নিষিদ্ধ ওষুধ, অস্থির জীবন — সবই ছিল। কিন্তু সেটিই তাকে আরও মানবিক করেছে। কারণ পবিত্রতা মানে নিখুঁত জীবন নয়, ভুলের পরেও উঠে দাঁড়ানোর সাহস। মেসি ছিলেন ল্যাবরেটরিতে গড়া জিনিয়াস; ম্যারাডোনা ছিলেন রাস্তায় জন্ম নেয়া বিপ্লবী প্রতিভা। মেসির গোল বেশি, ট্রফি বেশি — কিন্তু ম্যারাডোনা ছিলেন God of Naples। তার জন্যই নাপোলি আজও বিশ্বাস করে — ঈশ্বর ফুটবল খেলতেন, আর তার নাম ছিল ডিয়েগো।
ম্যারাডোনা ছিলেন প্রথম ফুটবলার যিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্যান কালচারের কেন্দ্রবিন্দু। কোনো ব্র্যান্ড বা মিডিয়া প্রচার ছাড়াই, নিজের বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে তিনি তৈরি করেছিলেন এক অনন্ত অনুসারী গোষ্ঠী। আজকের দিনে খেলোয়াড়দের জন্য যে গান, ট্যাটু, ব্যানার, মুরাল দেখা যায় — তার শুরু হয়েছিল ম্যারাডোনার হাত ধরেই। তিনি শিখিয়েছিলেন — ফুটবল শুধু সাফল্যের মাপকাঠি নয়, এটি আত্মপরিচয়ের ঘোষণা।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি চলে গেছেন। কিন্তু নেপলস আজও তার নামে গির্জায় প্রার্থনা করে। মৃত্যুর দিন শহরে আলো নিভে যায়, দোকান বন্ধ হয়, গির্জায় ঘণ্টা বাজে। এক শিশুর লেখা এখনও দেখা যায় দেয়ালে— “আমরা এখনো বিশ্বাস করি, তুমি একদিন ফিরে আসবে।”
ডিয়েগো ম্যারাডোনা হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তার শেখানো কথাটি আজও অনন্ত — “ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটা বিশ্বাসের নাম।”
God didn’t send him to win matches. He sent him to teach the world — football is not math, it’s faith.
শুভ জন্মদিন, এল ডিয়েগো — ফুটবল ঈশ্বর, বিপ্লবের প্রতীক।
সায়ন্তন ভট্টাচার্য 













