চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামমুখী সৈকত এক্সপ্রেসে মঙ্গলবার রাতে ধাক্কা দিয়েছে একটি হাতি।
তাতে যাত্রী বা ট্রেনের তেমন ক্ষতি না হলেও এভাবে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। ট্রেনের গতি কম থাকায় এই যাত্রায় রক্ষা মিলেছে বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তারা।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে প্রায় কাছাকাছি স্থানে ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতির মৃত্যু হয়। চুনতি অভয়ারণ্যের ওই অংশে পাঁচটি দলের প্রায় ৪৫টি হাতি নিয়মিত চলাচল করে।
গেল রাতে কী ঘটেছিল
মঙ্গলবার নির্ধারিত রাত সময় ৮টার বদলে ৮টা ৫০মিনিটে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটি। ট্রেনের ১৭টি বগিতে যাত্রী ছিল প্রায় ৫০০ জন।
রাত ১০টা ২৫ মিনিটে লোহাগাড়া উপজেলার (হারবাং সেকশনে) চুনতি অভয়ারণ্যে এলাকায় পৌঁছায় ট্রেনটি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ট্রেন চালক আবদুল আউয়াল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর পর চুনতি অভয়ারণ্যের ৪ কিলোমিটার অংশে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা আছে। তাই ট্রেন কম গতিতে চলছিল।
“হঠাৎ একটি হাতি আমার চোখে পড়ে। সেটি তখন লাইনে হাঁটছিল। আমি সাথে সাথে ব্রেক অ্যাপ্লাই করি। হুইসেল দিই। হেডলাইট চোখে পড়ায় এবং হুইসেলের শব্দে সেটি লাইন ছেড়ে নেমে যায়। কিন্তু ওই সময় পাশে লাইনের নিচে কয়েকটি হাতি ছিল। এর মধ্যে একটি ট্রেনের পিছনের অংশে আঘাত করে।”
এই ঘটনার সময় ট্রেন যাত্রীদের করা একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, একটি হাতি উত্তেজিত হয়ে রেললাইনের পাশের একটি কালভার্টের উপর দিয়ে এসে ট্রেনে আঘাত করছে। এসময় হাতিটি উত্তেজিত হয়ে ডাক দিচ্ছিল।
যাত্রীরা এসময় ভীত হয়ে ট্রেনের জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে হাতিটিকে দেখছিল। জন্তুটি কয়েকবার ট্রেনের গায়ে মাথা দিয়ে আঘাত করে।
ট্রেন চালক আবদুল আউয়াল বলেন, “গার্ড রুমে ও পেছনের দিকের বগিতে হাতিটি আঘাত করছিল। সেসময় গার্ড আমাকে ফোন করে জানায়, হাতি ট্রেনে আঘাত করছে। পরে আমি সাথে সাথে ট্রেন আবার টান দিই।”
দ্রুত ওই স্থান থেকে সরে না এলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি শুরুতে লাইনে থাকা হাতিটি না সরত, তাহলে আমি ট্রেন চালু করতে পারতাম না। অথবা যদি পাশে থাকা হাতির পালের সব হাতি মিলে হামলা করত, তাহলে বড় বিপদ হতে পারত।”
এর আগেও বিভিন্ন সময় চুনতি অভয়ারণ্যের ওই অংশে হাতির পায়ের ছাপ ও মল দেখেছেন জানিয়ে ট্রেন চালক আবদুল আউয়াল বলেন, “তবে আগে কখনো হাতি দেখিনি। এবারই প্রথম দেখলাম।
“রেললাইনের বাম পাশে ব্যারিয়ারের কিছু অংশ খালি আছে। ওই এলাকার কিছু অংশে উভয় পাশে ব্যারিয়ার আছে। কাছাকাছি ওভারপাস থাকলেও হাতি নিচের খোলা অংশ দিয়েই চলাচল করে। এই ঘটনা একটা মেসেজ। কারণ চলাচলের পথে বাধা এলে হাতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।”
ওই ট্রেনের যাত্রী রিদুয়ান কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরুতে ট্রেন থেমে যায়। হয়তো চালক হাতি দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এরপর মানুষ চিৎকার শুরু করে।
“এরপর হাতি তেড়ে আসে। তখন সাথে সাথে ট্রেন টান না দিলে হয়ত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। আমি এই পথের নিয়মিত যাত্রী। তবে আগে কখনো হাতি দেখিনি।”
হাতি চলে আগের পথে
গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাতে ৪-৫টি হাতির একটি দল চুনতি অভায়রণ্যের ওই অংশে চলাচলের সময় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেন একটি হাতিকে ধাক্কা দেয়।
এতে আট-দশ বছর বয়সী একটি মাদি হাতি গুরুতর আহত হয়। হাতিটির মেরুদণ্ড ও পা ভেঙে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাতিটি মারা যায়।
ওই ঘটনার পর চুনতি অভয়ারণ্যের চার কিলোমিটার অংশের ট্রেনের গতিসীমা নির্ধারণ করে রেলওয়ে। পাশাপাশি সেখানে রেললাইনের দু’পাশে ব্যারিয়ার নির্মাণের সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তারপর ব্যারিয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হলেও এখনো পুরো অংশে কাজ শেষ হয়নি।
বুধবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে চুনতি অভয়ারণ্য বণ্যপ্রাণী ও সংরক্ষণ কর্মকর্তা নূরজাহান বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসেছি। রাতে ঘটনার সময় আমাদের স্থানীয় রেঞ্জের কর্মচারী উপস্থিত ছিল। আমরা পায়ের ছাপও দেখেছি। একটিই হাতি ছিল।
“এখানে যে অংশে ব্যারিয়ার নেই, সেই অংশ দিয়ে হাতিটি প্রবেশ করে। কিন্তু রেল লাইনের বিপরীত পাশে ব্যারিয়ার আছে। তাই হাতিটি সেদিক দিকে পার হতে পারেনি। পরে সেটি আবার রেল লাইনের বাম পাশে এসে সেখান দিয়ে রেঞ্জ অফিসের দিকে এগুতে থাকে। ওই সময়ই ট্রেন এসে পড়ে।”
নূরজাহান বেগম বলেন, “সেখানে একটি কালভার্ট আছে। ট্রেনের যাত্রীরা হাতি দেখে চিৎকার শুরু করায় সেটি কালভার্টের উপর দিয়ে এসে ট্রেনে আঘাত করে। একটি গাছও ভেঙেছে হাতিটি। পাশ থেকে ট্রেনের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছিল বারবার। চালক দ্রুত ট্রেন সরিয়ে ফেলে।
“এরপর কালভার্টের রেলিং ভেঙে হাতিটি রেঞ্জ অফিসের পাশ দিয়ে হাইওয়ের দিকে চলে যায়। রেল লাইনের এই অংশ হাতির পুরাতন করিডর। পুরো অংশে ব্যারিয়ার না থাকায় হাতি পুরনো করিডর ধরেই পারাপার হয়।”
তিনি বলেন, “ব্যারিয়ার দিলে পুরো দিতে হবে। তখন হয়ত হাতি বাধ্য হয়ে ওভারপাস দিয়ে চলাচল করবে।”
চুনতি অভয়ারণ্যের ওই অংশে ৫টি হাতির দলে মোট ৪৫টির মত হাতি আছে জানিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, “একটি দলে বাচ্চাসহ সর্বোচ্চ ২০টি পর্যন্ত হাতি আছে। আবার একটি হাতি আছে, যেটি একা চলাচল করে। সেটি লেজকাটা।”
সেন্সর বসানোর সুপারিশ ছিল
দেশে এশীয় হাতির অন্যতম প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র চুনতি অভয়ারণ্য। এই বনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনে শুরু থেকেই নানা সমালোচনা ছিল। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তখন ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ এবং বনায়নের কথা জানিয়ে আশ্বস্ত করেছিল।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে হাতি চলাচলের অনেক পুরনো করিডর। ওই এলাকায় রেললাইন নির্মাণে অনেক শর্ত দেওয়া হয়েছিল।
“এর মধ্যে ছিল ট্রেনে সাউন্ড সেন্সর, থার্মাল সেন্সর বা লোকো মোটর সেন্সর সংযোজন করা; যাতে সামনে কিছু থাকলে চালক আগে থেকে জানতে পারে। এছাড়া হাতির চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস করার প্রস্তাব ছিল। সেগুলো করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে হাতির সাকসেসফুল মুভমেন্ট হচ্ছে না।”
দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, “হয়ত এগুলো হাতির প্রয়োজনীয়তার নিরিখে হয়নি; তাই হাতি ব্যবহার করছে না।”
ট্রেনের পথে বা পাশে হাতি দেখলে ট্রেন যাত্রীদের উত্তেজিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “হাতিটি কিন্তু শুরুতে লাইনের পাশে নিচু এলাকায় ছিল। সেটি সরে যাচ্ছিল। উৎসুক জনতার চিৎকারে সেটি ফিরে আসে।
“কেউ চিৎকার করছিল, কেউ ছবি-ভিডিও তুলছিল। মানুষের উচিত হাতিকে উত্যক্ত না করা।”
চুনতি অভায়রণ্য অংশে ব্যারিয়ার নির্মাণ, করিডরের কার্যকারিতা ও সেন্সর বসানোর সুপারিশের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সবুক্তগীন, প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা এবং চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ সফিকুর রহমানকে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি।