Friday, May 17, 2024

২৯ এপ্রিল ১৯৯১ এবং তারপর…

 

সেদিন-১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল;১৯৯১ সালের এই দিনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ড ভণ্ড করে দিয়েছিল বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকা কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সীতাকুণ্ড পতেঙ্গাসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল। এদিন এ অঞ্চলে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা) এবং তার সাথে ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাস। এই ঝড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ এবং তার চেয়েও বেশি মানুষ আহত হয়। আশ্রয়হীন হয়েছিল কোটি মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির বিচারে এই ঘূর্ণিঝড় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হিশেবে পরিচিত।

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়েছিল ২২শে এপ্রিল থেকেই। ২৪ এপ্রিল নিম্ন চাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে রাতে আঘাত হানে এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে।
ক্ষয় ক্ষতির কারণ হিসেবে পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘সেসময় অনেকেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা বুঝতে পারেনি বলে সাইক্লোন শেল্টারে যায়নি। বার বার মাইকিং করা সত্ত্বেও বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চায়নি’। এটাও ঠিক যে তখন সাইক্লোন শেল্টারও যথেষ্ট ছিল না। যাবেই বা কোথায়? পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ সময়ে অনেকে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়ে যাবার সময় বৃদ্ধ মা-বাবাকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে গেছেন- এমন গল্পও আমরা উপকূলের লোকজনের কাছে শুনেছি। বাতাসের তীব্র গতিতে গাছের সাথে দুলতে দুলতে কেউ কেউ বেঁচেও গিয়েছিলেন, আবার ভেসেও গেছেন এমন দুঃখের কথাও আমরা শুনেছি মহেশখালীর মাতারবাড়ি-ধলঘাটার মানুষের কাছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিভিন্ন এলাকায় গেলে জানা গেছিল অনেক কথা। অনেক নারীরা বলেছিলেন আমরা গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি রেখে যাই কেমন করে? এটা নিয়ে অনেকে হেসেছিলেন, কিন্তু ওদের কথায় এটা পরিষ্কার ছিল যে, পরিবার বলতে ওদের কাছে শুধু মানুষ নয়, ঘরের পশু পাখিও তাদের পরিবারের অংশ। তাদের ফেলে যাবেন- এমন স্বার্থপর তারা নন। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে গবাদী পশু রাখার ব্যবস্থা তখন ছিল না, এখন এ ব্যবস্থা হয়েছে/হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তখন করা হয়েছিল কেবল মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা। আবার এই মানুষ যখন অন্য প্রাণির জন্যে আকুল হয় তখন তাদের সচেতনতার অভাবের কথাও বলতে শুনা যায় অনেকের কাছে। এটি সচেতনতা না কি তাদের মানবতার প্রকাশ সেটা বিবেচ্য বিষয়। সে মানবিকতাও দরকার আছে। সেটা থাকলে মানুষ অন্তত এতোটা হিংস্র হতে পারতো না। সেটা নাই বলেই মানুষ কথায় কথায় খুন করে। প্যারাবন খুন তো নস্যি কথা!

কি কারণে-
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় অনেক বেশি মাত্রার ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু এতো ক্ষয়ক্ষতি কি শুধুমাত্র সে কারণেই হয়েছে? এতো তীব্র মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হলে তো ক্ষয়ক্ষতি হবেই। কিন্তু মানুষের কি কোনো দায় নেই? এতোদিনেও এই কথাটি কেউ বলছেন না যে রপ্তানি মুখী চিংড়ি চাষের জন্যে গত শতাব্দীর আশির দশকে উপকূল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ ধ্বংশ করে ঘের বানানো হয়। গত কয়েক বছরে তা আবার পুরোদমে চলছে। চকরিয়া সুন্দর বনের প্রায় ৩৫৭৭ হেক্টর বন এলাকা চিংড়ির জন্যে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল সে সময়। চিংড়ি রপ্তানি করে দেশে ডলার আসবে তাই এর নাম হয়েছিল ‘হোয়াইটগোল্ড’। সোনালী আঁশ পাট ধ্বংশ করে সাদা সোনার দিকে ছুটে ছিলাম আমরা। গত শতকের ৮০-৯০ ধশকে এই চিংড়ি চাষ ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করলে অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনাও হতো তখন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর মানুষের আহাজারির মধ্যে শুনতে পাই প্যারাবন ধ্বংশের কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। তাই এলাকার মানুষের পরামর্শে ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়ন থেকে মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার কেওড়া ও বাইন লাগানো হয়, আবার ১৯৯৭ সালেও ৫০ একর জমিতে লাগানো হয় এসব বনজ। ধাপে ধাপে এই প্যারাবন লাগাবার কাজ চলছে যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বলাবাহুল্য, এখনও চিংড়ি ঘেরের ব্যবসায়ীরা সুযোগ এলেই গাছ কাটতে উদ্যত হয় এবং প্রায় সময় এটি করেই ফেলে। ১৯৯১ সালের পর ছোট-বড় আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় হয়, কিন্তু যেখানে প্যারাবনের গাছ গুলো বড় হয়ে গেছে সেখানে ক্ষয়-ক্ষতি অনেক কম হয়েছে, যেখানে প্যারাবন ছিল না বা গাছ বড় হতে পারেনি সেখানে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক- এটা প্রমাণিত। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা প্যারাবন কেটে ঘের বানিয়েছে এবং প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাঁধ মেরামত করছে অথচ প্যারাবন দিয়ে ঘেরা জায়গায় কোনো বাঁধ নষ্ট হয়নি।

ভিন্ন না কি প্রাসঙ্গিক-
এক সময় এ প্যারাবনে প্রচুর পরিমানে উলুখেড় (উলুঘাস) ছিল। উলুখেড় (উলুঘাস) গরু ও ছাগলের জন্য খুব ভাল খাদ্য। কয়েক মাস একাধারে গরু ও ছাগলকে এই ঘাস খাওয়ালে গরু-ছাগল মোটাতাজা হয়ে উঠে। অন্যান্য ঘাস ও গাছ পালা আপনা থেকে গজিয়ে ওঠে। প্যারাবনে প্রচুর পাখি, কাঁকড়া ও মাছ দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে মাছেরা ডিম দেওয়ার জন্য প্যারাবনে চলে আসে। প্যারাবনের ভিতরে ও আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। প্যারাবনের এলাকা মাছের ডিম পাড়ার জন্যে খুব ভালো জায়গা, পাতা এবং শেকড় মাছের খাদ্য হিশেবেও খুব ভালো।
উপকূল এলাকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এবং মহিলা কেওড়া ফলের মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে কেওড়া ফল খায়। অধিকাংশ কেওড়ার ফল পাকার পর গাছ থেকে ঝরে পড়ে। সেই ফলের বীজ থেকে কেওড়া ও বাইন গাছের নীচে হাজার হাজার ছোট ছোট চারা গজিয়ে ওঠে, যা আবার নতুন করে লাগানো যায়। পাখিদের আনা-গোনাও অনেক বেড়ে যায় বিশেষ করে বক, পাখি, টিয়া, ঘুঘু, চড়াই, ডাহুক, পানকৌড়িসহ অনেক পাখি দেখা যায়। কিছু বন্যপশু তাদের খাদ্য খুঁজে পায় এখানে।
কেওড়া চারার তুলনায় বাইন চারা অনেক বেশি দেখা যায়। কেওড়ার গাছ তুলনা মূলক দূর্বল, এ জন্য ডাল-পালা ভাঙ্গে বেশি। তবে লোকজন এই ভাঙ্গা ডালপালা নিয়ে যায় রান্নার খড়ি হিশেবে। অন্য দিকে বাইনের গাছ এতো শক্ত যে ছোট ডালে প্রাপ্ত বয়স্ক একজন উঠলেও ডাল ভাঙ্গেনা। কেওড়া গাছের পাতা খুবই নরম এবং গরু ছাগলের খুব পছন্দের।

জাগতে হবে-
ভয়াল ২৯শে এপ্রিল স্মরণ করতে গিয়ে বলতে চাই, এই তান্ডবের ভয়াবহ ক্ষতি কেবলই প্রকৃতির কারণে নয়, মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের ফলও আছে। প্যারাবন ধ্বংশ করে যে ডলার এসেছে তা সাধারণ জনগণের কোন উপকারে লেগেছে কি না সে প্রশ্ন করাই যায়। চিংড়ির ব্যাবসাও এখন আগের মতো রমরমা নয়। কারণ, পশ্চিমা দেশে এখন “সচেতনতা” বেড়েছে, তারা এন্টিবায়োটিক দেওয়া চিংড়ি খাবে না বলে দিয়েছে। আমাদের বলার সময় এসেছে- প্যারাবন ধ্বংশ করা চিংড়ি খাবো না।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে বন্যা খরার মতো ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং আমাদের উপকূল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশ্বে চিহ্নিত হয়ে আছে। নীতি নির্ধারণী আলোচনায় ম্যানগ্রোভ রক্ষার জন্যে উদ্যোগ নেওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

আক্ষেপ না কি ব্যর্থতা-
আজকে এখানে স্মরণ করতে হচ্ছে- ১৭৯৮ সালের ৩০ মার্চ হতে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বৃটিশ আমলা ও চিকিৎসক ফ্রান্সিস বুকানন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে বৃহত্তম চট্টগ্রাম ভ্রমণের অংশ হিশেবে মহেশখালী ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্তের কয়েকটি ছত্র এরকম-
“Muscally by nature is a delightful island,…….. It might perhaps be of advantage to the Company, to make dams a cross the mouths of all the creeks, which admit the tide into Mascally, and thus to encourage the natives to clear the land.” (প্রকৃতিগতভাবে মহেশখালী একটি অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ,……… কোম্পানির জন্য ইহা অত্যন্ত লাভজনক হবে, যে সকল নদ-নদী-খাল-নালা দিয়ে মহেশখালীতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বাঁধ নির্মাণ করে ইহাদের মুখ বন্ধ করা এবং অতপর স্থানীয় জনগণকে ভূমি সংস্কার করার জন্য উৎসাহিত করা।) (মহেশখালী বাংলা বানানে প্রচলিত রীতি অনুসরণ করেছি)।

বুকাননের বর্ণনায় আরো কয়েকটি ছত্র এরকম- “The most esteemed trees, growing naturally on Mascally, are the Boidea and Doolea Gurgeons; the Bassua and Keta Jarools (Lagerstromia Flos Reginae of Konig, and a variety of it with a thorny stem) of which the last is most esteemed; the Tetuia Taelsaree; the Hoorina Ussual (a Species of Vitex); the good gootea; the Soondur (Heritiera littoralis Hort: Kew: which is really a Sterculea); and the Roona, which in the Soonderbunds is called Pursur. this is a Species of Trichilia not described)”. (মহেশখালীতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত গাছসমূহের মধ্যে গর্জন, জারুল, তেতুল, তেশ্বল, আশ্বল, সুন্দর, গুটগুটিয়া, চান্দুল, রুনা, হরিনা ইত্যাদি অতি মূল্যবান।)

বুকানন খুব কম এলাকা ঘুরে এসব গাছের অস্থিত্ব পেয়েছিলেন এবং তার বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। এসব গাছের কয়টি এখন দেখতে পাই? প্রায়ই এখন বিলুপ্ত। যা আছে সংখ্যায় খুব নগণ্য।
ভয়াল ২৯ এপ্রিল যেন আর না আসে সেই চেষ্টা কি আমরা করছি? ঘূর্ণিঝড় ঠেকানো না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি তো ঠেকাতে পারি।

গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকীর আক্ষেপ উল্লেখ করেই এ লেখার ইতি টানতে হচ্ছে- ‘দুইশত পঁচিশ বছর আগে ফ্রান্সিস বুকানন কর্তৃক বৃহত্তর স্বার্থে প্রস্তাবিত কোনো সুপারিশই আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি’। উল্লেখ্য, বুকানন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুবিধার্থে কোম্পানিকে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নারিকেলের চাষাবাদ করার এবং মশলা চাষের মতো তিনটি লাভজনক কাজের সুপারিশ করেছিলেন। যা বাস্তবায়ন হলে মূলত মহেশখালী দ্বীপ ও দ্বীপের মানুষের স্বার্থই রক্ষিত হতো সবচেয়ে বেশি।

শোক ও সমবেদনা-
২৯ এপ্রিল ১৯৯১ তারিখে প্রাণ হারানো সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা।

লেখক- মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন, পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

আরও খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয় সংবাদ

You cannot copy content of this page