‘নাগরিক’ যাপিত জীবন যখন গানের কথায় আর সুরে বাঁধতে শুরু হলো, তখন থেকেই মানুষ হয়তো নগরকে অনুভব করতে শুরু করলো! বাংলায় গত কয়েক দশক ধরেই এই ‘নগর জীবনকে’ ছুঁতে শুরু করে গান।
ওপারে কলকাতা ঘিরে কবির সুমন-অঞ্জনরা, আর এপারে সঞ্জিবের পর হয়তো শিরোনামহীন গাইলো ‘রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে’, চিরকুট গাইছে ‘এই শহর জাদুর শহর’, এখন এসে সানি গাইছে- ‘এ শহর দেয়নি কিছুই- শুধু তোমাকে ছাড়া’!
কিন্তু এই রাজধানীর ‘নগর জীবন’ ছাড়াও আরো কতো কতো নগর আছে! সেই খবর রাখে কী কেউ!
সমুদ্র ঘেঁষে উপকূলীয় নগর কক্সবাজার। এ নগরের মানুষের বিষাদ -বেদনা- আনন্দের সুর বাজাতেই যেনো সৃষ্টি গানের দল পেনোয়ার। নগরের আদি নামে দলের নামকরণও হলো তাই!
পেনোয়া তার নাড়ি পোঁতা মাটির গন্ধ শুঁকতে চায়। আর তাই সুর বাঁধলো – “আধা রাইত্তা জোনাক ফর’ত কুহু ডাকের হন, হইলজা ধরি টান মারের, অচিন দরদ বন…” আপনি যদি উপকূলীয় মানুষের বিষাদ ছুঁতে চান, তবে এ গানের সুর আপনাকে নিশ্চিত কলিজা ধরেই টান দেবে!
সম্প্রতি গানের দলটি রাজধানী ঢাকায় প্রথমবারের মতো মঞ্চ আলোকিত করেছেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা ও সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রেরন্দ্রের দুটি সন্ধ্যা দখলে রাখে পেনোয়া।
ঢাকার মুগ্ধ দর্শকরাও তাই পেনোয়ার প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে।
শিল্পী ও সাংবাদিক তুহিন কান্তি দাস লিখেন- “গোডা আসমান বাই গিয়ে এন এককান চান”
কী সুন্দর কথা! এই আকাংখা-হতশা স্বপ্ন-সম্ভাবনার শহরে যেন স্নিগ্ধ বাতাস। অনেকদিন পর Penoa গানের দলের গান শুনেছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। এতো চমৎকার কথা আর সুরের মায়া। শুভকামনা, বাংলা গানের আসমানে নতুন দিগন্ত হয়ে উঠুক পেনোয়া৷”
নুরেন দুর্দানি নামে একজন লিখেছেন, “নভেম্বর রেইনের সন্ধ্যায়, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র ‘…….’ পরীবাগের উঠোনে গিয়ে দেখি চেয়ারভর্তি শ্রোতা। বৃষ্টি নেমেছে আমরাও রেইনে কে উপেক্ষা করে গাছের তলায় বসে উপভোগ করলাম ‘এ রুহের তলে’ থিমে ‘পেণোয়া’ ব্যান্ডের গানের জার্নি। ‘…….’ সুন্দর লিরিকাল জার্নিতে অবশেষে আরও একটা মাস ফুরিয়ে আসছে, নভেম্বর এর সমাপ্তি দিন। ডিসেম্বর শহর তোমার মতো যেনো শীতের আগমনী সুর তুলছে, বার্তা নিয়ে আসছে সুন্দরের.. অপেক্ষায়..
সাংবাদিক শরীফ খিয়াম লিখেন, “ঢাকায় বসে পাওয়া
কক্সবাজারের নোনা হাওয়া। Thanks a lot Penoa ”
এমন অনেক প্রশংসায় ভেসেছে দরিয়া পাড়ের ব্যান্ডটি। ঢাকা থেকে ফেরার পর পেনোয়ার সদস্যদের সাথে কথা হয় টিটিএনের। তাদের সবার কাছেই জানতে চাওয়া হয়- রাজধানী থেকে কেমন ভালোবাসা নিয়ে ফিরলো?
ব্যান্ডের সদস্য ও সুরকার ভগবান রুদ্র বলেন, “ঢাকায় গিয়ে আমরা দর্শক এবং শ্রোতাদের কাছ থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি, তা সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করেছে। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং গান শুনতে আগ্রহ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। ঢাকার পরিবেশে আমাদের সঙ্গীতের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং সমর্থন স্পষ্টতই অনুভব করেছি। এটি আমাদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ঢাকার শ্রোতারা আমাদের গানকে গভীরভাবে গ্রহণ করেছেন, যা আমাদের ভবিষ্যতের কাজগুলোতে আরও উদ্যম নিয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে।”
ব্যান্ডের আরেক সদস্য ও গীতিকার ইয়াসির আরাফাত বলেন, “কত পুরানো শহর আমদের কাছে ঢাকা, তাও মনে হলো যেন প্রথমবার গিয়েছি। এতো ভালোবাসা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো ব্যস্ত-আত্মকেন্দ্রিক শহরটা, কখনো কল্পনাও করিনি। অথচ তাদের হৃদয় হতে উৎসারিত আলো আমদের পূর্ণ করেছে। আমাদের গানের এমন সমজদার শ্রোতা পেয়ে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। এমন আশাতীত ভালোবাসায় আমাদের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে।”
আড়ষ্ট হয়ে থাকা ব্যান্ডের সদস্য ও ভোকাল রথিন পাল তো জানালেন যাত্রাপথের ভাবনা টুকুও। রথিন বলেন, আমার গানের দীর্ঘ যাত্রায় বিভিন্ন জায়গায় শো করেছি, এমনকি ঢাকায় পড়াশোনা চলাকালীন বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমি গান করেছি।তবে এইবারের ঢাকা ট্যুর টা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা। কিছু মৌলিক গান ফেরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকাবাসীর কাছে। একটা নতুন ব্যান্ড, নতুন কিছু গান, নতুন অডিয়েন্স, সেই সাথে ছিলাম আমরা ব্যান্ড পেনোয়া। ঢাকা যাওয়ার পথে ভাবছিলাম আমাদের এই নতুন, অচেনা গান গুলো তাদের ভালো লাগবে কিনা, তাদের মনে জায়গা করে নিতে পারবে কিনা আমাদের গান। আমরা নভেম্বরের ২৮ এবং ৩০ তারিখ যথাক্রমে আলিয়ঁস ফ্রান্সেজ এবং সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে দুইটা শো করি। আমাদের গান গুলো তাদের কাছে এতো ভালো লাগবে, তাদের এত অ্যাপ্রেসিয়েশন পাব ভাবিনি। ঢাকাবাসীর ভালোবাসায় আমরা ব্যান্ড পেনোয়া সিক্ত।”
ব্যান্ডের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ১৮ ছুঁই ছুঁই বয়সের ড্রামার অনিন্দ্য পাল জিৎ এর হাসিই বলে দিচ্ছিলো তার দারুণ অনুভূতি।
বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোনার অঞ্চল, যেটি ছিলো আগে হলুদ ফুলের দেশ! আর নাম ছিলো পেনোয়া। এখন কক্সবাজার। এই আদি নাম ধরে হলুদ ফুলের সৌরভ ফেরি করতে চায় ব্যান্ডদল পেনোয়া। অনেকটা নিভৃতে এই উপকূলীয় নগরের মানুষের হৃদয় পেরিয়ে বঙ্গভূমিতে ছড়িয়ে পরছে তারা।
প্রথম এলবাম ‘এ রুহের তলে’ প্রকাশ হয়েছে ইউটিউবে। ধীরে ধীরে সীমানা পেরুচ্ছে পেনোয়া। লক্ষ শ্রোতার নজর কেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর ভালোবাসার আলোচনা এসেছে কাঁটাতারের ওপার বাংলা থেকেও।