চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। চালু হওয়ার পর থেকে গেলো ২০ মাসে এই রেল লাইনে প্রাণহানি হয়েছে ৩০ জনের।
সর্বশেষ শনিবার দুপুরে রামু উপজেলার রশিদনগর ও ভারুয়াখালী সড়কের লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় ঢাকামুখি ট্রেন একটি অটোরিকশাকে টেনে নিয়ে যায় অন্তত ১ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। এতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া অটোরিকশা চালক ও একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইজিবাইক চালক নবাব মিয়ার সাথে কথা হয় আমাদের। জানালেন সেই মর্মান্তিক দৃশ্যপট।
নবাব মিয়া জানান, প্রতিনিয়ত আতংকে গাড়ী নিয়ে তার লেভেল ক্রসিং পার হতে হয়। এই স্থানে কোন গেটম্যান না থাকায় ট্রেন আসা-যাওয়ার আনুমানিক সিডিউল মেনে চলাচল করেন তারা। কিন্তু সেদিন দুর্ঘটনা কবলিত অটোরিকশাটির চালক লেভেল ক্রসিংয়ে অপেক্ষায় থাকা অন্য গাড়ী চালকদের কথা না শুনে পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
নবাব মিয়া বলেন, “আমরা তিনটা ইজিবাইক এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সিএনজি অটোরিকশাটি যখন ওভারটেক করে যাচ্ছিলো, আমরা তাকে নিষেধ করি যেতে। তখন সে বলে আমি পার হতে পারবো। মুহুর্তের মধ্যেই রেললাইনে উঠার সাথে সাথেই ট্রেন চলে আসে।”
“এরপর ট্রেনের সামনের অংশ সিএনজি অটোরিকশাটাকে ঠেলে নিয়ে যায়৷ এরমধ্যে ওখানে থাকা যাত্রীরা একজন একজন পড়তে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চালকের পা ছিঁড়ে পরে যায়। কিছু দূর গিয়ে ট্রেন থামে, তখন অটোরিকশাটিকে আলাদা করা হয় ট্রেন থেকে।”
নবাব মিয়ার ভাষ্য, ভারুয়াখালির যারা এই রাস্তায় গাড়ি চালান, তারা ট্রেনের সময়সূচি জানি। সাড়ে ১২ টা ও ১ টায় ট্রেন আসে। সেই সময় দেখে তারা আর লাইন পার হননা।
“আমাদেরও নিরাপত্তা নেই। এখানে গেইট ম্যান দরকার। লেভেল ক্রসিং এর পাশে রেললাইনটা যেভাবে এসেছে, সেখানে বাঁক নিয়েছে, যার ফলে গাছের জন্য আর ট্রেন দেখা যায়না”- বলেন ইজিবাইক চালক নবাব।
রেলওয়ের প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইনে মোট ৯টি সেকশন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেভেল ক্রসিং গেট রয়েছে ইসলামাবাদ-রামু সেকশনে। ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেকশনে ১৭টি লেভেল ক্রসিং আছে। কিন্তু গেট ও গেটম্যান রয়েছে মাত্র একটিতে। বাকি ১৬টিতে কোনো ব্যারিয়ার বা গেটম্যান কিছুই নেই।
এছাড়া রেলপথের দোহাজারী-কক্সবাজার অংশে রেল কর্তৃপক্ষের অর্থরাইজড এবং আন-অর্থারাইজড লেভেল ক্রসিং রয়েছে অন্তত ১৪৪ টি। বেশির ভাগরই গেটম্যান নেই।
এসব ক্রসিংই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
কক্সবাজার রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার গোলাম রব্বানী বলেন, অনেক সময় ব্রেক কষলেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না। তবে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথ ঘনিষ্ট মানুষের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কোথাও কোথাও গাছগাছালির ঘন জঙ্গলে ঢেকে থাকায় ট্রেন আসা-যাওয়াও চোখে পড়ে না। অনেক সময় চালকেরা হুইসেলও দেন না এবং কোন গেটম্যান না থাকায় বাড়িয়ে দেয় বিপদের আশঙ্কা।
কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, এই রেললাইনের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। কোথাও ঘন ঝোপঝাড়ে দৃশ্যমানতা একেবারেই নেই। এতে করে যাত্রী, চালক ও পথচারী—সবাই যেন ঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছে। এ রকম অবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা আটকানো কঠিন।
এদিকে রোববার দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং নিহতদের পরিবারের স্বজনদের খোঁজ খবর কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াছমিন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই রেলপথের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্পন্ন করে রেল কর্তৃপক্ষের কাছে এখনো হস্তান্তর করেনি। এতে রেল কর্তৃপক্ষেরও কার্যকর ও স্থায়ী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আপদকালীন সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এবং রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিরাপত্তা জোরদারে প্রচেষ্টা চলছে।
বিগত ২০১৮ সালে ১৮ হাজার কোটির বেশী টাকা ব্যয়ে দোহাজারি-কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।