Thursday, December 7, 2023

ঘোড়া মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে বঙ্গোপসাগর থেকে

আহমেদ গিয়াস :

ধ্রুপদী নৃত্য এবং রাজকীয় ও কাব্যিক জীবন ধারার কারণে বিশ্ববিখ্যাত সামুদ্রিক প্রাণী ঘোড়া মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে বঙ্গোপসাগর থেকে। একসময় সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া উপকূলে মাছটি ব্যাপকভাবে ধরা পড়লেও সাম্প্রতিককালে এর তেমন দেখা মিলছে না বলে জানান সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, কাব্যময়-ছন্দময় রাজকীয় জীবন ধারার কারণে সী-হর্স বা ঘোড়া মাছকে ‘সমুদ্রের রাজা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সী-ড্রাগনদের নিকটাত্মীয় এই সামুদ্রিক প্রাণীটির পুরুষ সঙ্গীটিরা তাদের দেহে নারী সংগীর ডিম ধারণ করে, নিষিক্ত ডিম নিজের দেহে বহন করে এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে বাচ্চা দেয়।

তিনি বলেন, একসময় কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরেও মাছটি ব্যাপকভাবে ধরা পড়তো। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রবালের মধ্যে এবং সোনাদিয়া দ্বীপের উপকূলে ঘোড়া মাছের ভাল বিচরণ ছিল। কিন্তু গত এক দশক ধরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে ঘোড়া মাছ।

তিনি জানান, বোরির বিজ্ঞানীরা সেন্টমার্টিনের প্রবাল নিয়ে গবেষণা করেন। প্রবাল হল ঘোড়া মাছের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র। অথচ গত কয়েক বছর ধরে সেন্টমার্টিনের প্রবালের মধ্যে ঘোড়া মাছের বিচরণ দেখা যাচ্ছে না।

কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার উপকূলে ঘোড়া মাছের দেখা মিলছে না। অথচ ৭/৮ বছর আগেও কিছু লোক সাগর থেকে মাছটি ধরে শুটকী বানিয়ে ব্যাগেজ মাল হিসাবে চীনে পাচার করতো বলে শুনেছি। রাজধানীর উত্তরাতে তাদের অফিসও ছিল। বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে জানাজানি হওয়ার পর পাচারকারী আত্মগোপনে চলে যায়।

কক্সবাজার শহরের ফিশারীঘাটস্থ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, ঘোড়া মাছ কেউ খায় না। এজন্য জেলেরা এ মাছ ধরে না। তবে মাঝেমধ্যে কক্সবাজার উপকূল থেকে ১০/১২ কিলোমিটার নীচে বঙ্গোপসাগরের ১২ বিও (১২ মিটার গভীরতা সম্পন্ন এলাকা) নামক এলাকায় খুঁটা জালে দুয়েকটি ঘোড়া মাছ অন্যান্য মাছের সাথে ধরা পড়তে দেখা যায়। কিন্তু ৩/৪ মাস ধরে মাছটি একেবারেই দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, এক সময় ঘোড়া মাছের শুটকী চোরাইপথে চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী করা হতো। ওষুধী গুণসম্পন্ন এই মাছের প্রতি কেজি শুটকীর দাম প্রায় এক লাখ টাকা। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বন্য আইনে ঘোড়া মাছ ধরা, পরিবহণ ও বিক্রয় করা আইনত: দণ্ডনীয় অপরাধ।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, সীহর্সের গণ বা জেনাস হিপ্পোক্যাম্পাস (hippocampus)। গ্রীক শব্দ “হিপ্পোস (hippos)’ মানে ঘোড়া, আর ‘ক্যাম্পোস(kampos)’ মানে সমুদ্রের রাজা। এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটির এই পর্যন্ত ৪৭ টি প্রজাতি সনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্য ১৪টি প্রজাতি গত শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সী-হর্স দম্পতিরা মূলত সিরিয়াল মনোগামিস্ট, যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বা সারাজীবনের জন্য মাত্র একজন সঙ্গীর সাথেই থাকে। প্রতিদিন সকালে ঘোড়া মাছ দম্পতি একে অপরকে অভ্যর্থনা জানাতে আচারানুষ্ঠানিক নৃত্যে লিপ্ত হয়। জটিল, ছন্দময় ও ক্রম মোচড়ের মধ্য দিয়ে তাদের নৃত্য চলে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত। সী-হর্সের শরীরে শক্তিশালী বর্ম-সদৃশ প্লেটের একটি আবরণ থাকে। তাদের হাড় শক্ত। এ কারণে অন্যান্য মাছের পক্ষে তাদের হাড় হজম করা বেশ কঠিন।

বিজ্ঞানীরা জানান, ঘোড়ামাছ সাধারনত লম্বায় ১.৫ সে. মি. থেকে ৩৫ সে. মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের দেহের সামনের ভাগ ঘোড়ার মত ও পেছনের দিকে বাঁকানো লেজ আছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের গড় আয়ু ১-৫ বছর। প্রাপ্ত বয়স্ক সীহর্স প্রথমে সঙ্গী বাছাই করে। সাগরের প্রবাল উদ্যানে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী ঘোড়া মাছ পরষ্পরকে প্রাথমিক ভাবে পছন্দ হলে উভয়ে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা হতে কয়েকদিন পর্যন্ত বিবাহ পূর্ব ঘনিষ্ট প্রেমে আবদ্ধ হয়। বিজ্ঞানীরা সীহর্সের এই সময়কালকে নাম দিয়েছেন ‘সী-হর্সের কোর্টশিপ’ (courtship) হিসাবে। দীর্ঘ এই প্রেম পর্বে পরষ্পর সম্মত হলে এরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় । এরপর একে অপরকে আর ছেড়ে যায় না।

সীহর্সের বিবাহ পূর্ব এই প্রেম চলাকালিন সময়ে তারা উভয়ে দেহের রং পরিবর্তন করে। পরষ্পরের লেজ আকড়িয়ে ধরে সাঁতার কাটে, পরষ্পরের দেহের ঘনিষ্ট সংষ্পর্শে থাকে। একটি শৈবাল শাখা পেছিয়ে দুজনে অবসর কাটায়। কখনো দুজন আনন্দে নৃত্য করে। যাকে বিজ্ঞানীরা প্রিডন ড্যান্স (predawn dance) বলে থাকেন।

পুরুষ ঘোড়া মাছের পেটে একটি থলি রয়েছে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সিদ্ধান্তের পর পুরষটি তার পেটের থলিতে পানি দ্বারা পাম্প করে, যাতে থলিটি খালি ও উন্মুক্ত হয়। স্ত্রী ঘোড়া মাছ তখন পুরুষ সঙ্গীটির পেটের দিকে অবস্থিত বিশেষ থলেতে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া শেষে দুজনেই প্রথমে শৈবাল বনে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী অন্যত্র চলে যায় আর পুরুষটি নিজ দেহে রক্ষিত ডিমের যত্ন নিতে শৈবাল শাখায় গর্ভকালীন সময় কাটায়। এ সময় স্ত্রী মাছটি প্রতিদিন সকালে একবার করে পুরুষ মাছটিকে দেখতে আসে এবং সেবাযত্ন করে যায়। এভাবে ২ থেকে ৪ মাস গর্ভকালীন সময় শেষে পুরুষ ঘোড়া মাছটি ৫ থেকে ১৫০০টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে। আর সাধারনত রাতের বেলাতেই তারা বাচ্চা প্রসব করে। কারণ পর দিন সকালে যখন স্ত্রী মাছটি তাকে দেখতে আসবে, তখন যেন পুরুষ মাছটি নতুন করে ডিম গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ঘোড়া মাছের বাচ্চারা জন্মের পরপরই স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করে। সীহর্স কডার্টা পর্বের অস্থিময় মাছ। তবে এদের দেহে কোন আঁইশ নেই। এদের দেহজুড়ে পাতলা চামড়ার উপর রিং এর মতো আবরণ থাকে। প্রজাতি ভেদে এই রিং এর সংখ্যা আলাদা। আবার তাদের মাথায় মুকুটের (coronet) মতো যে অংশ থাকে তাও প্রজাতি ভেদে আলাদাই হয়ে থাকে। তবে এদের একটি মাত্র পৃষ্ঠীয় পাখনা থাকে। এই পৃষ্ঠীয় পাখনায় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৫বার দুলিয়ে এরা খুব ধীরে চলাচল করে।

বাঁকানো লেজের সাহায্যে এরা প্রবাল প্রাচিরের সামুদ্রিক আগাছা ও শৈবালের সাথে আঁকড়ে থাকে। প্রবাল প্রচীরের রঙিণ পরিবেশের সাথে মানিয়ে গায়ের রঙও পরিবর্তন করে; কখনো কালচে-বাদামি, কখনো ধূসর বা উজ্জ্বল হলদে। এরা তাদের চোখগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে নাড়াতে পারে।
এই মাছটি এ্যাকুরিয়ামে চাষের মাধ্যমে দেশের সুনীল অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলতে পারে বলে মনে করেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা।

আরও খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয় সংবাদ