জীবনটা আসলেই সুসজ্জিত এক মোটর গাড়ি, যেখানে সাওয়ারী করে আমি, আপনি, তুমি, সে ও তুই নামধারী কিছু যাত্রী। এই মোটর গাড়ি এক অদ্ভুত পীচ ঢালা পথে এগুতে থাকে, এক অন্যরকম গতিময়তায়। কিন্তু এই পীচ ঢালা পথ সব সময় মসৃণ হয় না। কিছুটা পথ এগুতেই সম্মুখীন হতে হয় এক একটা ভীমের সামনে। সে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রকানণ্ডতায়, নিজেকে জাহির করে হিমালয় বলে। যদি কেউ এই ভীমগুলো সহজভাবে অতিক্রম করতে পারে, তবেই সে পৌঁছাতে পারে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে।
এ ধরণের শত ভীম অতিক্রম করে বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় নারী জজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম সুইটি। তাঁর স্বামী রিয়াজও জুডিশিয়ারিতে কর্মরত আছেন। এর আগে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ১২তম বিজেএস পরীক্ষায় সারা দেশে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে বান্দরবানের প্রথম নারী জজ হয়েছিলেন ফারজানার বড় বোন আফসানা ইসলাম রুমি। তাঁরা দুজনই রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের মাঝিরকাটা গ্রামের জন্মজাত সন্তান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে ৮৯তম স্থান অধিকার করেছে ফারজানা ইসলাম সুইটি।
গত রোববার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন সচিবালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শরীফ এ এম রেজা জাকের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা যায়। এমন সু-সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ সহ বন্ধুপাড়ার সকলের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে।
সদা শান্ত ও পড়ালেখায় মনযোগী ফারজানা ইসলাম ইসলাম সুইটি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক জীবনে ছিলো অন্য বন্ধুর ছেয়ে আলাদা। শিক্ষক ও বাবা-মায়ের মন জয়ের পাশাপাশি বেশি সময় কাটাতেন পড়ালেখা নিয়ে। তিনি গর্জনিয়ার মাঝিরকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে প্রাথমিক বৃত্তি লাভের পর ২০১১ সালে গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন।
আফসানা ও ফারজানা বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তাদের বাবা নুরুল ইসলাম, দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য, এবং মা সাজেদা বেগম, যিনি এক, দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। সমাজে নারীর অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য সাজেদা বেগম ‘রত্নগর্ভা’ ও ‘শ্রেষ্ঠ জয়ীতা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
আফসানা, ফারজানা এবং তাদের বড় ভাই মুজাহিদুল ইসলাম—তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা যথাক্রমে ২০তম, ২২তম ও ১৮তম ব্যাচে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে মুজাহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এবং একইসঙ্গে বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইন পেশায় যুক্ত আছেন। পরিবারের ছোট সন্তান তাওসিফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করছেন।
তাদের বাবা নুরুল ইসলাম এই অর্জনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে এমন সন্তান দিয়েছেন, যারা ন্যায়ের পথে চলবে এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আমি চাই তারা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকুক।
মা সাজেদা বেগম জানান, শৈশব থেকেই তিনি সন্তানদের কঠোর শাসনের মধ্যে রেখেছিলেন, তবে তা শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, বরং তাদের সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য। তিনি বলেন, আমি সবসময় চেয়েছি, আমার সন্তানেরা সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে এবং কারও ক্ষতি করবে না। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। তারা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে এর প্রতিদান পায়।
এদিকে জজ হিসাবে চূড়ান্ত সুপারিশ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক মন্তব্যে ফারজানা ইসলাম সুইটি বলেন-
‘প্রতিকূলতাকে জয় করার স্পৃহা ছিল। সেই একাগ্রতার জোরেই অবশেষে সফল হলাম। এটা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম পাওয়া। আমি চেষ্টা করেছি। আল্লাহ তাআলা তার প্রতিদান দিয়েছেন। এর আগে আমি ১৪, ১৫ এবং ১৬ তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। ৩টা পরীক্ষায় আমি প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইভা দিয়েছি। কিন্তু ৩টা পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি। ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় সবশেষ খুশির খবরটা পেলাম।,
ফারজানা ইসলাম সুইটি আরও বলেন ‘বিচারকের আসন এমন একটা স্থান, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এটি ইবাদতের একটি মাধ্যম। হাদিসে আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার আরশের নিচে যেই সাত শ্রেণির ব্যক্তি ছায়া পাবেন, তার মধ্যে একজন হলো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।’